৩ দিনে ৪ জেলা ভ্রমণ – ঝিনাইদহ (পর্ব-৩)

‘চুয়াডাঙ্গা থেকে ঝিনাইদহ ভায়া কুষ্টিয়া’

চুয়াডাঙ্গার পর্ব পড়ে না থাকলে এখানে ক্লিক করে পড়ে আসুন

একটানা ছুটে চলার মাঝে ক্লান্তি যেমন আছে। আনন্দও আছে। এই ছুটে চলা আমাকে নেশার মত টানে।

যদি সম্ভব হয়,

যদি কোনদিন সুযোগ মিলে,

আমি ছুটে বেড়াতে চাই,

শুধু বাংলার পথে পথে নয়

পুরো পৃথিবী জুড়ে।

ঝিনাইদহ আসার ইচ্ছা ২০১৭ সাল থেকে। নির্দিষ্ট কোন কারন নেই, এমনিতেই। তবে এত বছরেও আসা হয় নাই ভয়ে। এবার যখন যাচ্ছি তখনো একা না, সাথে বন্ধু আছে।

যাই হোক যে ভয়ে এতদিন যাওয়া হয় নাই সে ভয় নাকি বেশ কয়েক বছর আগেই কেটে গেছে!

হাউসপুর ব্রিজ থেকে অটোতে জামজামী বাজার এসে বৃষ্টি বন্দী হলাম। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এক দোকানের নিচে আশ্রয় নিলাম।

বৃষ্টি দেখতে খারাপ লাগছিলো না। বাজারটাও বেশ জমজমাট, সুন্দর। তাড়া না থাকলে আরো অনেকটা সময় বৃষ্টি উপভোগ করা যেত।

হরিণাকুন্ড বাজার যেতে হবে অটোতে। অটোর সিরিয়াল থাকে। মানুষ হয়ে গেলে বৃষ্টির মধ্যেই ছেড়ে দিলো।

একসময় দেখি আমরা কুষ্টিয়ায় আছি। দোকানের ঠিকানায় কুষ্টিয়া লেখা। মানে হচ্ছে কুষ্টিয়া অতিক্রম করে ঝিনাইদহ যাচ্ছি। ছোট ছোট এমন বিষয়গুলো আমাকে দারুন আনন্দিত করে।

হরিণাকুন্ড বাজার থেকে বাস এবং অটো দুইভাবে ঝিনাইদহ সদর যাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে জানলাম বাসের থেকে অটোতে যাওয়াই ভালো। কারন লোকাল বাস যেতে অনেক সময় নিবে।

এখানেও সিরিয়ালের অটো। এখানে অটোতে প্রতিপাশে ৩ জন করে বসে, যেখানে ২ জন বসতেই কষ্ট হয়।

আমরা কষ্ট করতে রাজি না। তাই এক পাশের পুরোটা নিয়ে নিলাম। ২ জন যাবো, ৩ জনের ভাড়া দিবো।

দীর্ঘসময় চলার পর পরিতোষ ঠাকুর মোড় পৌঁছালাম। এখান থেকে মিয়ার দালান যাবো।

আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন

নবগঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষা মিয়ার দালান – ঝিনাইদহ জেলার সদর থানায় অবস্থিত জমিদার বাড়ি।

যদিও দালানের ছাদ থেকে নদী খুঁজে পাওয়া দায়। কচুরিপানা ভর্তি নবগঙ্গাকে নদী তো নয়-ই, খাল বলতেও সংকোচ হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদীর এমন করুন অবস্থা দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর তাই অবাক হই না।

সে যাই হোক, মিয়ার দালানে ফিরে আসি।

১২২৯ বঙ্গাব্দে তৎকালীন জমিদার সলিমুল্লাহ চৌধুরী বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৭৫হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটির কাজ শেষ হয় ১২৩৬ বঙ্গাব্দে।

সলিমুল্লাহ চৌধুরীকে স্থানীয় লোকজন মিয়া সাহেব নামে চিনতে বিধায় এই বাড়িটি মিয়ার দালান নামে পরচিত।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তিনি বাড়িটি সেলিম চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। তাই অনেকে সেলিম চৌধুরীর বাড়িও বলে থাকেন।

নবগঙ্গা নদীর উত্তরে অবস্থিত এই বাড়িটি নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, নদীর নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিলো। যার প্রবেশমুখ এখনো চিহ্নিত করা যায়৷

মিয়ার দালানের পাশেই রয়েছে বিশেষ একটি খেজুর গাছ। গাছটির রয়েছে একাধিক মাথা এবং প্রতিটি মাথা থেকেই রস আহরন করা যেত বলে শোনা যায়।

আমরা যখন মিয়ার দালানে পৌঁছাই তত বিকেল শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

পুরো বাড়িটি ঘুরে দেখলাম। ছাদ থেকে কচুরিপানা ভর্তি নবগঙ্গা নদী দেখলাম। নিচতলায় রহস্যময় ঠান্ডা এক রুমের সন্ধান মিললো। রুমে প্রবেশ করতেই গায়ে যেন হিম শীতল বাতাস বয়ে গেলো।

দূর থেকে দুই মাথা খেজুর গাছ দেখে মিয়ার দালান দর্শন শেষ হলো।

এবার যাবো ঢোল সমুদ্র দীঘি। যদিও সন্দিহান যে আলো থাকতে থাকতে পৌঁছাতে পারবো নাকি, তবু চেষ্টা করা যাক।

নাম সমুদ্র হলেও এটি মূলত দীঘি।

আমরা যখন দীঘির পাড়ে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আঁধো আলো, আঁধো অন্ধকারে বিশাল দীঘিটিকে কেমন রহস্যময় লাগছিলো।

রহস্য আরো বাড়াতে আমাদের এখানে নিয়ে আসা অটোচালক দীঘি নিয়ে প্রচলিত গল্প বর্ণণা করা শুরু করলেন।

প্রায় ৫২ বিঘা জায়গাজুড়ে বিস্তৃত দীঘিটি খনন করেন প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়। জনশ্রুতি রয়েছে, রাজা কোথায় গেলে তার সাথে থাকতো ১৬ হল্কা হাতি, ২০ হল্কা অশ্ব ও ২২০০ কোড়দার।

একবার রাজ্যে ভীষণ পানির কষ্ট দেখ দিলো। পানির অভাব পূরণের লক্ষ্যে রাজা দীঘি খনন করার সিন্ধান্ত নিলেন। বিশাল দীঘি খনন করা হলো, কিন্তু পানির দেখা নেই। একরাতে রাজা স্বপ্নে দেখলেন, রাণী দীঘিতে নেমে পূজো করলে পানির দেখা মিলবে। প্রজাদের কথা ভেবে পূজোর উদ্দেশ্যে রাণী দীঘিতে নামলেন। পূজো শেষ হতে দীঘির তল থেকে পানি উঠা শুরু হলো। পানি দেখে আনন্দে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজারা ঢাক ঢোল পিটিয়ে উল্লাস করা শুরু করলো। অন্যদিকে দ্রুত পানির বেগ বাড়তে থাকায় রাণী দীঘি থেকে পাড়ে উঠার আগেই ডুবে গেলেন। দীঘি পানি দিলেও, রাণী কেড়ে নিলো।

ঢোল সমুদ্র দীঘি দেখে এবার হোটেল খোঁজার পালা।

গুগল ঘেঁটে প্রথমে গেলাম হোটেল ড্রিম ইন ইন্টারন্যাশনাল। রুম প্রাইসের সাথে সার্ভিস না মেলায় বের হয়ে আসলাম।

আশেপাশে আর ভালো কিছু না পেয়ে গেলাম সুইট রেস্টুরেন্টের বিপরীতে রেডিয়েশন হোটেলে।

পুরো হোটেলে একটাই এসি রুম। ১৫০০ টাকা ভাড়া চাইলো। রুমের অবস্থা দেখে ৭০০-৮০০ টাকার বেশি দিতে ইচ্ছে হলো না। তবু ১০০০ টাকায় রাজি হলাম।

অথচ গতকাল রাতে চুয়াডাঙ্গায় ভিআইপি হোটেলের এসি রুমে ছিলাম ১৪০০ টাকায়। সাথে দুইজনের রাতের খাবার ও সকালের নাস্তা ফ্রি। রুমও এই হোটেলের চেয়ে ঢের ভালো।

যাই হোক এক রাতের মামলা। আমাদের চাহিদা মূলত দুইটা,

  • নির্বিঘ্ন ঘুমের পরিবেশ (ছারপোকামুক্ত আর কি)
  • এসির কুলুকুলু হাওয়া

হোটেল বয় যে ছিলো সে এক মজার ক্যারেক্টার। আধো ঘুম-আধো জাগরনে থাকে। মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকছিলাম, এই হোটেলে যে উঠলাম রাতে পুলিশ রেইড না দিলেই হয়!

থাকার বন্দোবস্ত করে উদরপূর্তি করতে জমজমাট সুইট হোটেলে হানা দিলাম।

চুই খাসি, ভাত, খাসির মাথা দিয়ে ডাল, সবজি, বোরহানি পানি দিয়ে জম্পেশ এক খাবার হলো। চুই খাসি যেমনটা আশা করেছিলাম তেমন না হলেও আশাহত হই নাই। দুইজনের পেটচুক্তি খাবারে বিল আসলো ৬৪০ টাকা।

আগামীকাল ট্যুরের শেষ দিন। কই থেকে কই যাবো রুট প্ল্যান সাজাতে বসলাম।

মাগুরা যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও সব ঘেঁটে নড়াইল যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম।

সকালে আবারও সুইট হোটেলে নাস্তা করলাম। নাস্তায় ছিলো পরোটা, খাসির লটপটি, ডাল-ভাজি, দই।

পায়রা চত্বর থেকে ব্যাটারি রিকশায় চলে গেলাম বিষয়খালি বাজার। সেখান থেকে অটোতে কালিগঞ্জ বাজার। তারপর হাসপাতাল মোড়। তারপর মল্লিকপুর বাজার। অবশেষে পৌঁছালাম কাঙ্খিত বটবৃক্ষ তলে।

এশিয়া মহাদেশের প্রাচীন ও অন্যতম বৃহত্তম বটগাছ

কালিগঞ্জ উপজেলার বেথুলী গ্রামে (মল্লিকপুর) প্রায় ২৫০-৩০০ বছর আগে স্থানীয় কুমারের কুয়ার দেওয়ালে এই বটগাছটি জন্মেছিলো।

মূল গাছটি মারা গেলেও এটি ৪৫টি ভিন্ন ভিন্ন গাছে প্রায় ২.০৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। এর ৩৪৫টি বায়বীয় মূল মাটিতে প্রবেশ করেছে এবং ৩৮টি মূল ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যমান!

মল্লিকপুরে প্রবেশের বেশ আগে থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। আমরা যখন বটগাছের কাছে পৌঁছাই পুরো চত্বর ভিজে চুপচপ অবস্থা। মাটি, কাঁদা হয়ে আছে। সাবধানে দেখে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে।

বট গাছ এরিয়া যতটা সম্ভব ঘুরে দেখলাম। বটগাছ প্রাঙ্গনে ছাউনি ও বসার জন্য ইট-সিমেন্টের তৈরি চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে।

গাছের ব্যপ্তি ও বিশালতা দেখে অবাক হয়েছি। এতকষ্ট করে এতদূর আসাটা বৃথা ছিলো না।

মল্লিকপুর বাজারে সিঙ্গারা, কাঁচাগোল্লা, জিলাপি খেলাম। আহামরি কোন স্বাদ না। গরম গরম জিলাপি দেখে লোভ হওয়ায় নেওয়া।

হাসপাতাল মোড় থেকে মল্লিকপুর আসার সময় মজার এক বাহনে চড়ি লাটা গাড়ি (স্থানীয় ভাষা)। স্যালো মেশিনের ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি সম্ভবত। মানুষের কত বুদ্ধি!

এবার যাবো বারোবাজার। সেখানে ৬ মসজিদ দেখবো।

এই শহরের প্রাচীন নাম ছিলো, মোহাম্মদাবাদ। ধারনা করা হয়, হযরত খান জাহান আলী (রাঃ) ১২ জন সহচর সহ এখানে আসার পর এর নাম হয়, বারোবাজার।

পুরো এলাকা জুড়ে ৯টি মসজিদ রয়েছে। তবে আমরা দেখেছি ৬টি।

মল্লিকপুর থেকে প্রথমে লাটা গাড়িতে বসুন্ধরা বাজার। সেখান থেকে অটোতে বারোবাজার। বারোবাজার থেকে ভ্যান রিজার্ভ করে মসজিদগুলো ঘুরে দেখি।

যেসব মসজিদে যাই,

  • শুকুর মল্লিক মসজিদ/হাসিলবাগ মসজিদ
  • পীর পুকুর মসজিদ
  • নুনগোলা মসজিদ
  • জোড়বাংলা মসজিদ
  • গলাকাটা মসজিদ
  • গোড়া মসজিদ

প্রথমে যাই শুকুর মল্লিক মসজিদ যার আরেকনাম হাসিলবাগ মসজিদ। এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট মসজিদ।

সেখানে থেকে পীর পুকুর মসজিদ। ১৬ গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটিকে মাটির নিচ থেকে খনন করে বের করা হয়েছে। মসজিদে ছাদ না থাকায় পরবর্তিতে সংস্কার করে টিনের ছাদ দেওয়া হয়েছে।

পীরপুকুর থেকে জোড়বাংলা মসজিদে যাওয়ার পথে দূর থেকে নুনগোলা মসজিদ দেখা যায়। বৃষ্টিতে কাঁদা কাঁদা থাকায় কাছে যাওয়া হয় নাই।

জোড়বাংলা মসজিদটি খননের সময় একটি ইট পাওয়া যায় যেখানে লেখা ছিলো, ৮০০ হিজরি। এ থেকে ধারনা করা হয়, মসজিদটি ৮০০ হিজরিতে নির্মিত।

ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট গলাকাটা মসজিদ নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, বারোবাজারের এক অত্যাচারী রাজা প্রজাদের বলি দিয়ে মসজিদের সামনের দীঘিতে ফেলে দিতো। তখন থেকে এর নাম হয় গলাকাটা মসজিদ।

৪ গম্বুজবিশিষ্ট গোড়া মসজিদের সামনেই একটি কবর। ধারনা করা হয় কবরটি গোড়াই নামে কোন এক দরবেশের। এ কারনে মসজিদের নাম হয়েছে গোড়া মসজিদ।

ঘুরে ঘুরে ৬টি মসজিদ দেখার সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটলো ঝিনাইদহ ভ্রমণের। এখন যাবো নড়াইল…

Never lose hope, never stop travelling

শেয়ার করে বন্ধুদের জানিয়ে দিন

Similar Posts