৩ দিনে ৪ জেলা ভ্রমণ – চুয়াডাঙ্গা (পর্ব-২)

‘মেহেরপুর থেকে অটোতে চুয়াডাঙ্গা’

পড়তে কেমন কেমন লাগলেও ঘটনা সত্য। কেদারগঞ্জ বাজার মেহেরপুরে অবস্থিত আর আটকবর বাসস্ট্যান্ড চুয়াডাঙ্গায়।

মেহেরপুরের পর্ব পড়ে না থাকলে এখানে ক্লিক করে পড়ে আসুন

আমাদের বর্তমান অবস্থান আটকবরে। এসেছি অটোতে। সে হিসেবে বলা যায়, অটোতে মেহেরপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা!

বাজারে সিঙ্গারা দেখে স্বাদ পরখ করতে হোটেলে ঢুকলাম। যেকোন জেলায় গিয়ে সিঙ্গারা পেলে চেখে দেখি। কারন কবি বলেছেন, সিঙ্গারা ইজ ভালোবাসা।

তেমন আহামরি লাগলো না। চলে টাইপ।

বাজারে আরো দেখা মিললো ‘ডিজিটাল গরু গাড়ির।’ মানে ব্যাটারি চালিত ভ্যানে আগেকার গরুর গাড়ির মত শেড দেওয়া।

সময় সুযোগ থাকলে চড়ে দেখতাম। সময় ছিলো না।

বাজার পরিদর্শন শেষে আটকবর কমপ্লেক্সে প্রবেশ করলাম। যা দেখার জন্য মূলত এখানে এসেছি।

আটকবর মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান। আটজন বীর মুক্তিযুদ্ধোকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে।

২০২২ সালে স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে ঘুরে কখনো কি উপলব্ধি করতে পারবো কিভাবে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে? কি ধরনের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা মিলেছে?

পারবো না জানি। কখনো সম্ভবও না। তবু জানার চেষ্টা করা। যতটুকু পারা যায় উপলব্ধি করা।

‘তালসারি ও ডিসি ইকোপার্কে নৌ-ভ্রমণ’

রাস্তার দুই পাশে সারি সারি তালগাছ। তাই নাম হয়েছে, তালসারি।

ডিসি ইকো পার্ক যেতে পথে তালসারির দেখা মিললো। সেদিন আবহাওয়া এমন ছিলো যে, মন ভরে উপভোগ করা গেছে।

আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন

ইকো পার্কের বিল দেখে আরেক দফা মন জুড়ালো। ৭৮ একর জায়গা জুড়ে বিশাল বিল। ঘুরে বেড়ানোর জন্য ময়ূরপঙ্খী নৌকা রয়েছে। এমন বিলে নৌকায় না চড়লে বড় অন্যায় হয়ে যাবে। সে অন্যায় করবো তার সাধ্য আমাদের নেই।

তবে রোদের তেজ বাঁধ সাধলো। তেজ কমার অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। এতে অবশ্য লাভ হলো। গতকাল রাত থেকে একটানা জার্নি করছি। কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ মিললো।

আমার জেলা ভ্রমণগুলোতে সারাদিন এমন জার্নির মধ্যেই যায়।

দীর্ঘদিন এমন পথ চলতে চলতে একসময় নিজে থেকে উপলব্ধি করা শুরি করি,

‘গন্তব্যস্থল থেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রাপথ বেশি রোমাঞ্চকর, আনন্দের।’

নৌকা চলতে শুরু করতেই কোথা থেকে একখন্ড মেঘ এসে হাজির। বৃষ্টি হলে ভালো হতো। গুনগুন করে গাওয়া যেতো,

‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান’

ইকো পার্ক ঘুরে আবার পথ চলা শুরু। যাবো কার্পাসডাঙ্গা সেখান থেকে দর্শনা। তারপর বর্ডার। তারপর চুয়াডাঙ্গা শহর। তারপর চলতে থাকা, চলতে থাকা…

কারন, আমাদের পথ চলাতেই আনন্দ!

দর্শনা কেরুর ফ্যাক্টরির কাছে গিয়ে জানলাম ফ্যাক্টরি বন্ধ। ভিতরের প্রবেশের ইচ্ছা ছিলো। তা আর পূরণ হলো না।

সারাদিন ঘুরে শরীর বেশ ক্লান্ত। এক দোকান থেকে কলা খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম।

এবার যাবো দর্শনা বর্ডার। কেরুর সামনে থেকে জয়নগর পর্যন্ত ভ্যান রিজার্ভ করা হলো। কিছুদূর যেতেই বৃষ্টি শুরু হলো। অগত্যা এক চায়ের দোকানে যাত্রা বিরতি। রিজভী চা নিলো। চা দোকান থেকে বৃষ্টি উপভোগ করতে খারাপ লাগছিলো না। কিন্তু আমাদের তাড়া আছে।

বৃষ্টি কমে আসলে আবার যাত্রা শুরু হলো।

জয়নগরে নেমে অটো নিলাম। এবার সরাসরি দর্শনা বর্ডার।

দর্শনা থাকা অবস্থায় পাথরবাহী ভারতীয় ট্রেনের দেখা মিললো।

২০১৬ সালে নিজের সাথে নিজে শপথ করেছিলাম ৬৪ জেলায় না গিয়ে পাসপোর্ট করবো না। যখন এই গল্প লিখছি তখন পাসপোর্ট করার শর্ত পূরণ হতে আর মাত্র ৪টা জেলা বাকি।

বিভিন্ন বর্ডারে যখন যাই তখন এপাড় থেকে দেখে চলে আসি, ওপাড়ে যাওয়া হয় না। একদিন হয়তো যাওয়া হবে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে পা রাখা হবে, মনুষ্য সৃষ্ট বর্ডারের ওপাড়ে…

ভারতের পাথরবাহী ট্রেন দেখে এখন চুয়াডাঙ্গা শহর যাবো।

দর্শনা থেকে দুইভাবে যাওয়া যায় অটো/ভ্যান/সিএনজিতে করে। অথবা সরাসরি ট্রেনে।

রেলস্টেশন যখন এসেছি ট্রেনে চড়ার সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায় না।

মাত্র ১৫ টাকায় চুয়াডাঙ্গার টিকেট কেটে নিলাম। অন্য উপায়ে গেলে কমপক্ষে ১০০ টাকা খরচ হতো।

বেশ ভীড়। তবে আমরা সিট পেলাম। ট্রেনে উঠলে বসে থাকার চেয়ে বগিগুলোতে ঘুরতেই বেশি ভালো লাগে।

কত ধরনের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। রেল নিয়ে আমার একটা ডায়লগ আছে,

‘বাস জার্নি মানে শুধুই বাস জার্নি, রেল জার্নি মানে গল্প’

যদিও কয়েকমাস আগে ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার সময় বিআরটিসি বাস এই ডায়লগকে কিছুটা মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। তাও সামগ্রিকভাবে বাস জার্নি মানে শুধুই বাস জার্নি।

বিভিন্ন বগিতে ঢুঁ মেরে বাকি সময় ট্রেনের গেটে দাঁড়িয়ে রইলাম। গেট থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে অসম্ভব ভালো লাগে। দু’পাশের স্থবিরতার মাঝে ছুটন্ত আমি, সাঁই সাঁই করে ছুটে চলি।

ট্রেন যখন খুব গতিতে থাকে তখন চারপাশ অস্পষ্ট দেখায়। আমাদের জীবনও অনেকটা এই গতিশীল ট্রেনের মত। কি এক অমোঘ নেশার টানে আমরা শুধু ছুটে বেড়াই।

আমাদের শুধুই তাড়া। রয়ে সয়ে জীবনকে দেখার তাড়না আমাদের কাজ করে না।

গতিশীল ট্রেন ভালো লাগলেও জীবনের ক্ষেত্রে আমার পছন্দ জীবনানন্দ দাশের কবিতার মত জীবন,

“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;

আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,

পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।

জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা

অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :

আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ

হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

নক্ষত্রের নিচে।”

তবে চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? পাওয়া সম্ভব!

চুয়াডাঙ্গা নেমে হোটেল খুঁজতে গিয়ে দারুন এক হোটেলের সন্ধান পেলাম। ১৪০০ টাকায় ডাবল বেডের এসি রুম। সাথে দুইজনের রাতের খাবার ও সকালের নাস্তা ফ্রি।

ডিনারে কি দেয় ভাবতে ভাবতে গিয়ে দেখি ভাত, ডাল, সবজি, রুই মাছ। খাবারের স্বাদ যেমন ভালো, পরিবেশও ভালো।

খাবার শেষে রাতের চুয়াডাঙ্গা শহরে কিছুটা সময় হাঁটাহাটি করে রুমে চলে গেলাম। প্রথম দিনের ভ্রমণ পর্ব এখানেই শেষ…

সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি আনলিমিটেড খিচুড়ি ও ডিম ভাজা দিয়ে নাস্তা করে নিলাম।

নাস্তার পর মিষ্টি মুখ করতে গেলাম কালিপদ দাস এন্ড সন্স মিষ্টির দোকানে। ১০০ বছরের বেশি পুরাতন এই দোকানে যা যা মিষ্টি খেলাম,

  • সন্দেশ
  • বরফি সন্দেশ
  • ছোট চমচম
  • কালোজাম
  • পানতোয়া

সবগুলো মিষ্টি বেশ মজা। দিনের শুরুটা ভালো হলো।

চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ২ কিলো দূরে ঠাকুরপুর জামে মসজিদ অবস্থিত। লোকমুখে জনশ্রুতি আছে জিনের সাহায্য মাত্র ১ দিনে এই মসজিদ নির্মান করা হয়েছে। তাই একে ‘জিনের মসজিদ’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।

ঠাকুরপুর মসজিদ দেখে গেলাম হাজার বছরের পুরানো ঘোলদাড়ী শাহী মসজিদ দেখতে। ধারনা করা হয়, ১০০৬ সালে এই মসজিদটি নির্মান করা হয়েছে।

যদিও নতুন সংস্কার দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি ১০০০ বছরের পুরাতন মসজিদ। সংস্কারের ধরন দেখে বেশ আশাহত হলাম।

এবার যাবো আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি। বধ্যভূমির গেটে তালা থাকায় ভিতরে প্রবেশ করা গেলো না। তবে দেয়াল নিচু হওয়ায় ভিতরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। দেখে ভালো লাগলো।

বধ্যভূমির বর্তমান রূপ দেখে কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না ১৯৭১ সালে এখানে কি হয়েছে। প্রায় ২ হাজার নারী-পুরুষের মৃতদেহ এই বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখা হয়েছিলো।

বধ্যভূমির পাশে বয়ে চলা নবগঙ্গা নদী দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। দূরে রেল ব্রিজ দেখা যাচ্ছিলো। আবহাওয়াও এমন ছিলো নদীর পাশে সারাদিন বসে থাকা যাবে। আমরাও বেশ অনেকটা সময় বসে ছিলাম।

চুয়াডাঙ্গা ভ্রমণ শেষ। এবার গন্তব্য নতুন জেলা, ঝিনাইদহ।

Never lose hope, never stop travelling

শেয়ার করে বন্ধুদের জানিয়ে দিন

Similar Posts