ভাসমান চাল বাজার ও বরিশাল ভ্রমণ – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯.২)
ভীমরুলি থেকে আবার কুড়িয়ানা যাচ্ছি। দুপুরে খাবার ব্যবস্থা ওখানে করা হয়েছে। ট্রলারের ছাদে বসার সুবিধা হচ্ছে পেয়ারা বা আমড়া গাছ থেকে পেড়ে খাওয়া যায়। আমরাও টপাটপ কয়েকটা পেড়ে খেলাম। বাগানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রলার থামিয়ে বাগানেও ঢুকলো কয়েকজন। বড় ট্রলারের একটা অসুবিধা হচ্ছে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। এজন্য কষা নৌকা হলে সুবিধা। (সতর্কতা, বাগান মালিকের অনুমতি ব্যতিত পেয়ারা বা আমড়া ছিঁড়ে খাবেন না)
আগের পর্বঃ ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমন
আমরা রাতে যেখানে থাকবো সেখানে চলে আসলাম। বড় এক মাঠ। মাঠের সাথেই খাল। খাবারের আগে গোসল করে নিতে হবে। আর এত বড় খাল থাকতে কে কল বা টিউবওয়েলের পানিতে গোসল করতে চায়? সব খালে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাঁতার না জানার শাস্তিস্বরূপ আমিসহ আরো কয়েকজন এক গাছের গুঁড়ি ধরে ভাসতে থাকলাম। সবাই যখন ঝাঁপাঝাপি করছে আমাদের তখন পাড়ের গাছই ভরসা। দীর্ঘসময় ধরে গোসল চললো। আমাদের সামনে দিয়ে ট্রলার যায়, কষা নৌকা যায়। আমরা মনের আনন্দে গোসল করি। শহরে বড় হওয়া আমার জন্য এ এক দারুন অভিজ্ঞতা।
গোসল শেষে সবাই খেতে বসলাম। বিশাল প্যান্ডেল টানিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই কিছুটা বিশ্রাম নিলো। আমরা কয়েকজন এক ব্রিজের উপর গিয়ে বসলাম। দুপুরের পর খাল নিরব হয়ে পড়ে। দিনে দিনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ভীড় কমে যায়। তখন শুধু স্থানীয়দের নৌকার আনোগোনা দেখা যায়।
বিকালে ট্রলার নিয়ে আবার ঘুরতে বের হলাম। আঁকাবাঁকা খাল বেয়ে আমরা চললাম স্বরূপকাঠি লঞ্চ ঘাটের দিকে। আকাশ জুড়ে ধূসর-কালো মেঘেদের আনাগোনা। খালের দু’পাশ জুড়ে সবুজের ছড়াছড়ি। নাম না জানা পাখির ডাক। শান্ত স্নায়ু আরো শান্ত হয়ে আসে। পৃথিবীর সব ব্যস্ততাকে ঠেলে দিয়ে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে হয় বাংলা মায়ের কোলে। মনে মনে জীবনানন্দ দাশের কবিতা আড়য়াই,
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
স্বরূপকাঠি লঞ্চ ঘাট আসাতে আবার সন্ধ্যা নদীর সাথে সাক্ষাত হলো। নদীতে ঢেউ এখনো কমে নি। তবে এবার আর তেমন ভয় লাগলো না। লঞ্চঘাটে নেমে কিছুক্ষন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করা হলো। চা খাওয়া হলো। তারপর ঠিক সন্ধ্যার মরা আলোতে ট্রলারে চেপে বসলাম।
নদী ছেড়ে আমরা যখন খালে পড়লাম তখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। দু’হাত দূরের কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। তবু এই অস্পষ্ট পথ বেয়ে চলছে আমাদের দক্ষ মাঝি ভাই। আকাশে ততক্ষনে তারাদের মেলা বসেছে। মেঘের আড়াল থেকে ক্ষনিক পর পর উঁকি দিচ্ছে স্পতর্ষী। ট্রলারের ছাদে শুয়ে সেই আকাশ দেখতে দেখতে বাঁচতে ইচ্ছে হয় আরো বহু বহু বছর।
কুড়িয়ানা বাজার ছোট হলেও দুপুরে একরূপ, সন্ধ্যেতে আরেক রূপ। বাজারের ঋতুপর্ণা দোকানের রসগোল্লা না খেলেই যেন নয়, আহা অমৃত। গরম গরম মিষ্টির স্বাদই আলাদা। রাতে খাবার খেতে হবে জানি তবু বৌদির দোকানে ভাত খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। গরম গরম মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম। পরের টা পরে দেখা যাবে।
রাতে শোবার ব্যবস্থা হয়েছে স্কুল ঘরে। বিশাল বড় ঘরে চাদর বিছিয়ে ঘুমাতে হবে। অনেকে শুয়ে পড়লেও আমার ঘুম আসছিলো না। খালের পাড়ে বসে আমরা কয়েকজন অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। নিশুতি রাতে তারাদের মেলা বসেছে। নিস্তব্ধ রাতের আধাঁরে দূষণ মুক্ত আকাশে তারাগুলো কেমন জ্বল জ্বল করছিলো। হঠাৎ হঠাৎ দূরে কোথাও নাম না জানা কোন পাখি ডাক দেয়। গা ছম ছম করে উঠে। পানি থেকে মাছেরাও ক্ষনিক পর পর লাফিয়ে উঠে জানান দেয় আমরাও আছি।
ঘুমাতে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেলো। একেক জনের নাকের গর্জনে রুম কাঁপছিলো। ঘুমাবো কিভাবে চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে শরীর ক্লান্ত থাকায় দ্রুতই ঘুম চলে আসলো।
খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে রুম থেকে বের হয়ে দেখি আরো কয়েকজন ইতিমধ্যে উঠে গেছে। বাকিরা এখনো ঘুম। হাঁটতে বের হলাম। চারপাশ যত দেখছিলাম, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। একজনকে দেখলাম ছোট ডোবার মধ্যে মাছ ধরছে। জোয়ারের পানি যখন বাড়ে তখন ডোবা ঢুবে যায়। ভাটার সময় পানি নেমে যায়, তখন মাছ আটকা পড়ে। সেই মাছ ধরার চেষ্টা। মিললে মিললো, না মিললেও ক্ষতি নাই। ঘন্টাখানেক চেষ্টা চলবে। যে সময় আমাদের ফেসবুকের স্ক্রলেই চলে যায়!
সকালে নাস্তা করে বের হলাম ভাসমান চালের বাজার দেখতে। বাজারটা বেশ মজার। চাল ভর্তি নৌকাগুলো একসাথে জড়ো হয়ে থাকে। ক্রেতারা নৌকা বা ট্রলারে করে আসে। নৌকাতেই দরদাম হয়, ওজন হয় এরপর কিনে আবার নৌকাতে করেই নিয়ে যায়। আমাদের সাথের কয়েকজনও চাল কিনলো।
ভাসমান বাজার ঘোরা শেষ। ব্যাকওয়াটার আর সন্ধ্যা নদীকে বিদায় জানিয়ে আবার রিজার্ভ বাসে উঠে পড়লাম। এবার আর নিচে না বসে বাসের ছাদে বসলাম। ছাদ থেকে দু’পাশের যে দৃশ্য দেখা যায় এক কথায় অসাধারন। তবে ছাদের বসার কিছু যন্ত্রণাও আছে। রাস্তার দু’পাশের গাছের ডালের দিকে সবসময় নজর রাখতে হয়। নাহলে কখন যে গালে, মাথায় বাড়ি বসিয়ে দিবে বোঝা দায়। দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
আমরা প্রথমে গেলাম চাখার শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘর। সেখানে জাদুঘর দেখে চলে গেলাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ বা গুঠিয়া মসজিদ। মসজিদটা অনেক সুন্দর। রাতে নাকি আরো সুন্দর লাগে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এর অবস্থান। মসজিদের পিছে মুক্ত বিশাল আকাশ। দেখতে বড্ড ভালো লাগে। আমরা মসজিদের থাকা অবস্থায় বৃষ্টি শুরু হয়। মসজিদের লাগোয়া পুকুরে অনেকে গোসল করতে নেমে পড়ে। আমিও আর বাদ থাকবো কেন? আমিও নেমে পড়ি। উপরে হিম শীতল বৃষ্টির ফোঁঁটা আর নিচে পুকুরের গরম পানি। অল্প কিছু সময় গোসল করেই উঠে পড়ি। গুঠিয়ার সন্দেশ বেশ বিখ্যাত। মসজিদের সামনের দোকান থেকে সন্দেশ খেলাম। এবার যাবো দুর্গা সাগর দীঘি।
দুর্গাসাগর থেকে গুঠিয়া মসজিদের দূরত্ব বেশি না। দুর্গাসাগরে টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হয়। ভিতরে রয়েছে বিশাল এক দীঘি, দীঘির চারপাশে ১.৬ কিলোমিটার হাঁটার ট্রেইল। দীঘির মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপও আছে। শুনলাম সেখানে নাকি সাপেদের আস্তানা।
দুর্গাসাগরে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়ার আগে প্রায় দুই ঘন্টা গোসল করলাম। সাঁতার শেখার ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম। সিঁড়ি ধরে দুই পা ভাসিয়ে রাখা ছাড়া কিন্তু তেমন লাভ হলো না। তবে শরীর চাঙ্গা হয়ে গেলো। গোসলের পর পুরো ট্রেইলে চক্কর দিলাম।
বিকেল নাগাদ আমরা বরিশাল শহরের দিকে রওনা হলাম। বরিশাল শহর মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। হক মিষ্টান্ন, শশী মিষ্টি, নিতাই বেশ জনপ্রিয়। আমরা প্রথমে গেলাম হক মিষ্টান্নতে। সেখানে রসগোল্লা, রসমালাই খেয়ে গেলাম শশী মিষ্টান্নতে। শশীর মিষ্টি খেয়ে চলে গেলাম বি.এম কলেজে। সন্ধ্যা পর্যন্ত বি.এম কলেজের পুকুর পাড়ে বসে সময় কাটালাম।
আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যায় বিবির পুকুর পাড়ে আড্ডা বসলো। এরমধ্যে খবর পাওয়া গেলো মাহমুদ ভাই সবাইকে দধি ঘরে দই খাওয়াচ্ছে। দলে দলে সবাই হানা দিলো। দই খেয়ে সবাই লঞ্চে চলে গেলাম।
লঞ্চের ডেকে যে যার মত করে ঘাটি গেড়ে নিলো। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর তবু ভীষণ চাঙ্গা মন। এই ভ্রমণের আগ পর্যন্ত সমুদ্র, পাহাড়, ঝর্ণা দেখা আমার, কোন ধারনাও ছিলো না এমন সৌন্দর্যও আছে…