আনারস বাগান দেখতে মধুপুর, মন্ডা খেতে মুক্তাগাছা – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০)
ভাসমান পেয়ারা বাজার ঘুরে আসার পর অনেকদিন কোথাও যাওয়া যায় না (প্রায় ১৬ দিন)। লিচু বাগান, লটকন বাগান, পেয়ারা বাগান দেখার পর এবার ইচ্ছা হলো আনারস বাগান দেখবো। টাঙ্গাইলের মধুপুরে আনারস বাগান আছে। শুধু আনারস দেখতে না গিয়ে আশেপাশে দেখার মত আর কি কি আছে খুঁজতে শুরু করলাম। খোঁজ নিয়ে বের হলো টাঙ্গাইল, মধুপুর, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ ঘুরে দেখা সম্ভব হতে পারে। সেই মোতাবেক প্ল্যান করলাম।
দুই বন্ধু ফাহিম আর হৃদয়কে বলতেই রাজি হলো। হৃদয় বললো রাতে ওর বাসায় থাকতে। ভোরে তাহলে একসাথে যাওয়া যাবে। প্ল্যান অনুযায়ী শুক্রবার খুব সকালে সিএনজি নিয়ে মহাখালী চলে আসলাম। নিরালা বাসে টাঙ্গাইল যাবো। আমরা বাস স্টেশনে গিয়ে শুনে তখনই একটা বাস ছেড়ে যাবে কিন্তু কোন সিট নাই। তবে বনেটে বসে যাওয়া যাবে। আগে কখনো বনেটে বসে কোথাও যাই নাই। দামাদামি করে উঠে পড়লাম। ১৬০ টাকা ভাড়া, ১০০ দিবো।
বনেটে বসে প্রথমে মাথায় আসলো বোকামি হয়ে গেছে। সিটে বসে আরাম করে ঘুমিয়ে গেলেই পারতাম। তবে কিছু সময় পর মনে হলো, নাহ বনেটে বসেও মজা আছে। ড্রাইভারের পাশে বসে দেখতে দেখতে যাওয়া। রাস্তার দু’পাশে সবুজের সমারোহ। বনেট গরম হওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু বেশ উপভোগ্যই ছিলো!
সকাল ৬.৩৮ মিনিটে ছেড়ে আসা বাসে ৯ টার মধ্যে টাঙ্গাইল পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে গেলাম। এখানে নামার কারন হচ্ছে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চমচম খাবো। জয়কালী দোকানের চমচম খেতে হবে খবর নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দোকানে গিয়ে শুনি খুচরা চমচম বিক্রি করে না। চমচমের ছবি তুলে তাই পাশের পোড়াবাড়ি চমচমে গেলাম। এখানে খুচরা বিক্রি হয়। চমচম মুখে দিয়েই বুঝলাম কেনো তা এত বিখ্যাত। স্বাদ সত্যিই অসাধারণ! তবে এরপর দেশের নানা প্রান্তে এমন মজার চমচম অনেক জায়গাতেই খাওয়া হয়েছে।
আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন
চমচম খেয়ে সন্তোষে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মাজার এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গেলাম। বেশ বড় জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশাল খেলার মাঠ আর বিশাল এক পুকুর। বেশ পছন্দ হলো। ছবি তুলে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে বের হয়ে আসলাম। যাবো করটিয়া জমিদার বাড়ি।
পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড থেকে করটিয়ার সিএনজি পাওয়া যায়। আশেপাশের দৃশ্য দেখে তো অবাক। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। বন্যার পানিতে মাঠ-ঘাট পানিতে টইটুম্বুর। কোন কোন বাসার উঠান পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে মানুষ চলাচল করছে। ফাহিমের ভাষ্যমতে, গাছের গোড়া ডুবে সৃষ্টি হয়েছে রাতারগুল! সে এক মনোরম দৃশ্য, দর্শক হিসেবে। সেখানে থাকলে কি দুর্ভোগ হত তা চিন্তার বাইরে!
করটিয়া নেমে মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে করটিয়া জমিদার বাড়ি খুঁজে বের করলাম। কিন্তু গেট বন্ধ। কোন মানুষও নেই। পরে বাইরের কয়েকজন বললো, এটার ভিতর ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাজারের ভিতর দিয়ে আরেকটা বড় জমিদার বাড়ি আছে। বড় জমিদার বাড়ির সন্ধানে বের হলাম। যাওয়ার পথে করটিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের দেখা পেলাম, দেখতে বেশ সুন্দর।
এক লোক আমাদেরকে বেশ কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে বড় জমিদার বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলো। সরু এক গলি দিয়ে ঢুকে জমিদার বাড়ি খুঁজে পেলাম। বেশ বড় এরিয়া। জমিদার বাড়িটি বর্তমানে স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জমিদার বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। পুকুরের ঘাটটাও আমার পছন্দ হলো। যদিও তেমন আহামরি কোন ঘাট না।
করটিয়া ঘোরা শেষ। এখন যাবো মধুপুরের আনারস বাগান ও আনারসের হাট দেখতে। মধুপুর যেতে হলে প্রথমে টাঙ্গাইল নতুন বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। নতুন বাসষ্ট্যান্ড দুইভাবে যাওয়া যায়; বাসে করে অথবা সিএনজিতে। আমরা সিএনজিতেই রওনা হলাম। নতুন বাস স্ট্যান্ড এসে টিকেট কেটে প্রান্তিক বাসে চেপে বসলাম। মধুপুর যাওয়ার রাস্তাটাও সুন্দর। সত্যি বলতে বর্ষাকালে প্রকৃতি তার রূপের ঢালি নিয়ে হাজির হয়। যাই দেখি, তাই ভালো লাগে। দেড় ঘন্টা পর আমরা মধুপুর নামলাম।
মধুপুর নেমে চৌরাস্তায় দেখি বিশাল আনারসের ভাস্কর্য। বুঝলাম আনারসের শহরে চলে আসছি। জুম্মার নামাজ পড়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্ত্যবস্থল জলছত্র বাজারের দিকে রওনা দিলাম। বাজারে যাওয়ার পথে দেখলাম আনারস নিয়ে ভ্যান আসতেছে।
জলছত্র হাটে গিয়ে তো অবাক। যেদিকে তাকাই শুধু আনারস আর আনারস। ভ্যান বোঝাই করে আনারস তোলা হচ্ছে। ট্রাক, পিকআপে আনারস তোলা হচ্ছে। সবচেয়ে মজা লাগলো সাইকেল ভর্তি আনারস দেখে। সময় নিয়ে হাটে ঘোরাঘুরি করলাম। আনারস কেনাবেচা দেখলাম। আনারস পাকে আষাড়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। আনারসের হাট বসে শুক্র ও মঙ্গলবার। হাট বেশি জমজমাট হলে জলছত্র থেকে পঁচিশ মাইল পর্যন্ত লম্বা হয়।
হাট দেখা শেষ। এখন আনারস বাগান দেখতে দোখলা যেতে হবে। সমস্যা হলো দোখলা যাবার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা ভ্যান পাওয়া গেলো। তাতেই তিনজন চড়ে বসলাম।
ভ্যান করে দোখলা যাবার জার্নিটাই ছিলো এই ট্রিপের সবচেয়ে মজার পার্ট। রাস্তার দুইপাশে আনারসের বাগান। আমার ভাবতাম আনারস মাটির নিচে হয়। পরে হৃদয় হাসতে হাসতে বললো আনারস মাটির উপর হয়। মাটি ফুঁড়ে লাঠির মত বের হয় যার মাথায় আনারস থাকে। ছোটবেলা থেকে কত আনারস দেখেছি, খেয়েছি কিন্তু কখনো জানতামই না আনারস গাছ দেখতে কেমন বা কিভাবে হয়। এক ভ্রমণ যে জীবনে কত কিছু শিখিয়েছে!
আমরা মধুপুর বনের সামনে ভ্যান থেকে নামলাম। বনের ভিতরে রেস্ট হাউজ ও ওয়াচ টাওয়ার আছে। কিন্তু আমরা বনের ভিতরে না ঢুকে আবার ভ্যানে উঠলাম। ভ্যান চালক মামা বেশ অবাক হলো। বললো আপনারা তো মাত্রই আসলেন, ভিতরে যাবেন না। পরে নিজেই বললো, এখন অবশ্য দেখার মত তেমন কিছু নাই। আগে অনেক কিছু ছিলো। এখন গাছ কেটে বন ফাঁকা করে ফেলছে। পশু-পাখিও আগের মত নাই। আমরাও রাস্তার দুপাশে অনেক গাছের গুড়ি কেটে রাখা দেখলাম।
টাঙ্গাইল ঘোরা শেষ। এখন যাবো ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। মুক্তাগাছা রাজবাড়ি দেখতে ও বিখ্যাত মন্ডা খেতে। আবারও সেই প্রান্তিক বাস। ঘন্টাখানেক জার্নি শেষে বাস আমাদেরকে রাজবাড়ির গলির মুখে নামিয়ে দিলো। হেলেদুলে আশপাশ দেখতে দেখতে রাজবাড়ির গেটে গিয়ে দেখি গেট বন্ধ। ৬ টা বেজে গেছে। দর্শনার্থী প্রবেশের সময় শেষ। অনেক অনুরোধ করার পর ভিতরে ঢুকতে দিলো। ঢোকার পর পরই বললো, কিছু টিপস দিয়েন!
রাজবাড়িতে ঢোকার পর চারপাশে ভালোভাবে তাকানোর আগেই বললো প্রথমে একেবারে শেষমাথায় যান। পিছন থেকে দেখতে দেখতে আসেন। আমরা ভাবলাম কতটুকু বড়ই বা হবে! কিন্তু ভিতরে ঢুকতে গিয়ে অবাক। একের পর এক গেট পার হচ্ছি শেষ আর হয় না। বিশাল ব্যাপার স্যাপার। আসলেই যেন রাজবাড়ি। রাজবাড়িটা অনেক সুন্দর। তাড়াহুড়া করে যতটুকু পারা যায় দেখলাম আর ছবি তুললাম। তবে মন ভরে নাই। এত বিশাল বাড়ি যে ভালোভাবে পুরোটা দেখতে কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে।
রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে হাতের বাম পাশের গলি ধরে মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডার দোকানে চলে আসলাম। সুন্দর বসার ব্যবস্থা। চেয়ারে বসলেই দোকানের ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে, কয়টা মন্ডা খাবেন। আমরা অর্ডার করলাম। প্রতি পিছ মন্ডা ২২ টাকা। হাফ কেজিতে ১০ পিস থাকে। স্বাদ ভালো। তবে আমার কাছে তেমন আহামরি কিছু লাগে নাই। আমার পছন্দ কালোজাম, রসমালাই, স্পঞ্জ টাইপের মিষ্টি। দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মন্ডা খেয়ে আমাদের ভ্রমণ শেষ হলো।
এখন বাড়ি ফেরার পালা। এজন্য যেতে হবে ময়মনসিংহ। ট্রেন পেলে ট্রেন না হলে এনা বাস তো আছেই। ময়মনসিংহ যাওয়ার পথটা বেশ মজার ছিলো। বাসের একপাশের আকাশে দেখা যাচ্ছে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা। আরেকপাশ জুড়ে ঘনকালো মেঘের অশনি ছায়া। আমাদের বাস সেই মেঘের চাঙড়ের দিকে ছুটছে। হুট করে বৃষ্টির মধ্যে ঢুকে আবার হুট করেই বৃষ্টি থেকে বেড়িয়ে আসে। আমরা ময়মনসিংহ পৌঁছাই ৭.১৬ মিনিটে।
ট্রেন ধরার আশায় তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠি। কিন্তু রেলস্টেশন গিয়ে শুনে ঢাকার ট্রেন চলে গেছে। কি আর করা। মাসকান্দা বাসষ্ট্যান্ডে এসে এনার টিকেট কাটি। বাস ছাড়তে দেরি হবে সেসময়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই। বাসে ছাড়লে মনে মনে বললাম, নাহ! দিনটা ভালোই ছিলো।
এনা বাস আসলেই একটা জিনিস। ২০ মিনিট চলার পর আমাদের বাস নষ্ট হয়ে যায়। বাস ঠিক করতে ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে। ভাবলাম আজকে বাসায় যেতে যেতে অনেক রাত হবে। কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর বাস আমাকে খিলক্ষেত নামায়। মানে প্রায় দুই ঘন্টাতেই চলে আসছে। কোন ভুতুড়ে সুড়ঙ্গ ব্যবহার করছে কিনা বুঝলামা না। নাহলে কিভাবে সম্ভব! কিভাবে!