লিচুর খোঁজে ঈশ্বরদী সাথে লালন শাহ মাজার – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-৬)

লিচু বাগান দেখতে যাবো। দিনাজপুরের নাম সবার আগে মাথায় আসলেও আমি চাচ্ছিলাম অন্য কোথা যাওয়া যায় নাকি? ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, লিচু বাগান দেখতে কোথায় যাওয়া যায়? ভার্সিটির ছোট ভাই তন্ময় জানালো, “ঈশ্বরদী যান, অনেক লিচু বাগান আছে। তাছাড়া ঈশ্বরদী উপজেলা হলেও এমন অনেক কিছু আছে যা অনেক জেলাতেও নেই।”

তন্ময়ের কথা শুনে বেশ আগ্রহ হলো। এমন কিছুই তো চাচ্ছি। ওর সাথে কথা বলে ভ্রমণ পরিকল্পনা করে ফেললাম।

১৭ মে, ২০১৬। জীবনের প্রথম সোলো/একা ভ্রমণে বের হলাম। মনে মনে দারুন উত্তেজনা অনুভব করতেছিলাম। সেই উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে দিতে টিকেট ছাড়াই ধূমকেতু এক্সপেসে চড়ে বসলাম। অবশ্য বসলাম বললে ভুল হবে দুই বগির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম!

তখনো ট্রেনের সাথে বন্ধুত্ব হয় নি। ট্রেনের কিছুই জানি না। টিকেট করি নাই বিধায় দরজাতেই বসে পড়লাম। আর অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন টিটি আসবে?

টিটি এসে টিকেট চাইলো। বললাম টিকেট নাই। বললো ১৯০ টাকা দেন। আমিও সুবোধ বালকের মত দিয়ে দিলাম। বাসে গেলে দ্বিগুন ভাড়া লাগতো সেই টাকা বেঁচে যাওয়ায় মহা খুশি!

তবে তখনো অবাক হওয়ার বাকি। আমার সাথেই দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ছেলের কাছে টিকেট চাইলে ১০০ টাকা দিয়ে বললো আর টাকা নাই। টিটি যতই টাকা চায় বলে, আমি ছাত্র। ১০০ টাকাই আছে আর কোন টাকা নাই। বেশ কিছুক্ষন টাকা চাওয়া-চাওয়ির পর টিটি চলে গেলো। আমি মুগ্ধ নয়নে শিখলাম!

আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন

ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে নেমে নিজেকে কলোম্বাস মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো নতুন কোন দেশ আবিষ্কার করেছি। একা না আসলে এই অনুভূতি কি কখনো পেতাম?

রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে প্রথমে বাসের টিকেট করলাম। এখন পোস্ট অফিস মোড়ে যাবো পাবনার বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ খেতে পাবনা দই ঘরে। আমি এর আগে কখনো প্যারা সন্দেশ খাই নাই। আমার বেশ ভালো লাগলো।

প্রথমে যাবো লালন শাহ সেতু আর ১০০ বছরের পুরাতন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে। ঈশ্বরদী বাজার থেকে লোকাল অটোতে করে রুপপুর মোড়ে নামলাম। দূরত্ব দেখে ভেবেছিলাম ভাড়া হয়তো ৩০ টাকা হবে কিন্তু অটোওয়ালা যখন ১০ টাকা চাইলো যারপরনাই অবাক হলাম! শায়েস্তা খাঁ’র আমলে চলে এলাম নাকি?!

রুপপুর মোড় থেকে লালন শাহ সেতু দেড় কিলোর মত। লালন শাহ সেতু আর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাশাপাশি অবস্থিত। হাঁটাহাঁটির অভ্যাস থাকায় অটো বা সিএনজি না খুঁজে হাঁটা দিলাম।

সেতুর টোল প্লাজায় গিয়ে দেখি হেঁটে সেতু পার হওয়া যাবে না। অগত্যা সিএনজি নিলাম। লোকাল সিএনজিতে ১০ টাকায় সেতু পার হলাম। বাইক বা নিজস্ব গাড়ি থাকলে সেতুর উপর দাঁড়ানো যেত। লালন শাহ সেতু থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখা যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে সেতুর এপাড়ে পাবনা, ওপাড়ে কুষ্টিয়া। যখন শুনলাম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা মাত্র চার-পাঁচ কিলো ভাবলাম যাই ভেড়ামারয় ঢুঁ মেরে আসি। অদ্ভুত এক গাড়িতে করে ভেড়ামারা গেলাম। রেলস্টেশনের আশেপাশে কিছু সময় এদিক ওদিক ঘুরে সিএনজি নিয়ে আবার পাবনা চলে আসলাম।

এবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যাওয়া যাক। ইপিজেডের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চলে গেলাম। ব্রিজের নিচে পদ্মা নদী। নৌকায় করে পদ্মা নদীর মুক্ত বাতাস খাওয়ার সুযোগ থাকলেও একলা হওয়ায় সেই সাহস করলাম না। এমনিতেই সাঁতার পারি না। চলে গেলাম পাকশী রেলস্টেশনে।

প্রথম দর্শনেই পাকশী রেলস্টেশনের প্রেমে পড়ে গেলাম। রেলস্টেশন এত সুন্দর হতে পারে আমার ধারনা ছিলো না। হঠাৎ মনে স্বাধ জাগলো রেলব্রিজের উপর হাঁটবো। যদিও রেলব্রিজের উপর হাঁটা নিষেধ।

রেলব্রিজের উপর আমরা তখন ৪ জন ছিলাম। বাকি তিনজনও আমার মতই ঘুরতে এসেছে। বেশ কিছু সময় ধরে স্টেশন মাস্টারকে পটানোর চেষ্টা করার পর অনুমতি মিললো। আমরা তো মহা খুশি।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১৯১৫ সালে চালু হয়েছে। ১০০ বছরের পুরনো রেলব্রিজের উপর হাঁটতে নিজের কাছে দারুন লাগছিলো। আমার ভাগ্য বেশ ভালো ছিলো সেদিন। রেলস্টেশনে হাঁটাহাঁটি করার সময় ঢাকা-কলকাতা ট্রেন আসে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে ট্রেন যেতে দেখার অনুভূতি পাকশীতে অন্যরকম। ট্রেনের একটি ভিডিও করেছিলাম।

লালন শাহ সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখা শেষ। এবার লিচু বাগান দেখার পালা। তন্ময় ওর কয়েকজন বন্ধুকে বলে রাখছিলো আমি আসবো। ওদের নিজস্ব লিচু বাগান আছে। ফোনে যোগাযোগ করে রওনা হলাম।

তন্ময়ের বন্ধুরা যখন শুনলো আমি লিচু বাগান দেখতে একা ঈশ্বরদী আসছি মনে মনে বোধহয় পাগলই ভাবলো। ওদের চোখে মুখে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছিলো। যাই হোক এরপর আমরা লিচু বাগানে গেলাম যে বাগান দেখতে এতদূর আসা।

লিচু বাগান দেখে মজা পেলাম। কত শতাংশ(সঠিক মনে নেই) জায়গার মধ্যে শুধু একটা লিচু গাছ থাকতে পারে। অনেক গাছ দেখলাম লিচুর ভারে নুয়ে পড়ে যাচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে।

লিচু বাগান ২৪ ঘন্টা পাহারা দিতে হয়। দিনে ছাগল আর রাতে বাদুড়ের যন্ত্রণা। সাথে মানুষ তো আছেই। বাদুড়ের সমস্যা হচ্ছে, এরা লিচু খায় একটা নষ্ট করে ১০ টা। লিচু গাছের উপরে কাকতাড়ুয়া বা অনেকে পলিথিন দিয়ে রাখে পাখি তাড়ানোর জন্য।

বাগান থেকে নিজ হাতে লিচু পেড়ে খেলাম। বেশ আনন্দ লাগছিলো। ঘুরে ঘুরে বাগান দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। কত কিছু জানি না। অথচ চাইলেই জানা যায়। বাগান থেকে বের হওয়ার সময় তন্ময়ের বন্ধুরা সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য লিচু পেড়ে দিলো।

তন্ময়ের বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানলাম কুষ্টিয়ার লালন শাহ মাজার এখান থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্ব। এত কাছে এসে লালনের দরগড়ায় যাবে না এ হতেই পারে না।

বিপত্তি বাঁধলো আমি ঈশ্বরদী নেমেই ঢাকার বাসের টিকেট করে রেখেছিলাম। টিকেট তো ফেরত দিতে হবে। তন্ময়ের বন্ধুদের বেশ প্রভাব ছিলো এলাকায়। বাইকে করে কাউন্টারে গিয়ে টিকেট ফেরত দিয়ে আসলাম। ওরা না থাকলে টিকেট ফেরত নিতো না!

ঈশ্বরদীকে বিদায় জানিয়ে কুষ্টিয়া রওনা হলাম। ৫০ মিনিট পর বাস মজমপুর গেটে নামিয়ে দিলো। কুষ্টিয়া নেমেই একটা ভুল করলাম। ছোট মামাকে ফোন দিয়ে বললাম আমি কুষ্টিয়া আসছি। আজকে রাতেই আবার ঢাকা চলে যাবো।

ফোন রেখে মানুষকে জিজ্ঞাসা করে অটোতে করে লালন শাহ মাজারে রওনা হলাম। রাতের ওই সময়টাতে একা অটোতে যেতে ভয় ভয় লাগছিলো কিন্তু কৌতুহল তো মেটাতে হবে। লালন শাহ মাজারের সামনে নেমে দেখলাম কোথাও কেউ নেই।

প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসলো, ফিরতিপথে অটো পাবো তো? পরের টা পরে দেখা যাবে ভেবে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কেমন থমথমে পরিবেশ। দুরুদুরু বুকে সামনে আগাচ্ছি। ভিতরে গিয়ে দেখলাম কয়েকজন মানুষ বসে আছে আর লালন সংগীত হচ্ছে।

সে সময়, সে পরিবেশে দাঁড়িয়ে গান শোনার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। শরীরের প্রতিটা পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো। আনন্দে, উত্তেজনায়, খুশিতে ও ভয়ে।

মামাকে ফোন দিয়ে জানানোর মাশুল হিসেবে বড় খালু ফোন দিলো। বড় খালুর বাসা কুষ্টিয়ায়। আমি এত রাতে লালন শাহ মাজারে একা শুনে বকা দিলো। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বললো। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আমি তো কারো বাসায় যাওয়ার জন্য আসি নাই। আমি আসছি নিজের মত করে ঘুরে দেখতে!

ভগ্ন হৃদয়ে তিনটা গান শুনে আবার মজমপুর গেটে রওনা হলাম। আমার কাজিন এসে বাসায় নিয়ে গেলো। খালুর বাসায় গিয়ে গোসল করে, রাতের খাবার খেয়ে আবার মজমপুর গেটে চলে আসলাম।

তন্ময় বার বার বলে দিছিলো কুষ্টিয়া থেকে এসবি সুপার ডিলাক্স পরিবহনে উঠতে। আমিও এসবি পরিবহনে টিকেট করলাম। ৪৫০ টাকার টিকেট দামাদামি করে ৪০০ টাকায় কেটে বেশ গর্ব হচ্ছিলো। সেই গর্ব চুরমার হলো যখন দেখলাম এস.এবি মনে করে এস.এফ পরিবহনে টিকেট কেটে ফেলছি। এই ভুলের মাশুল সারা রাস্তা দিতে হলে। পুরো রাস্তায় এমন কোন জায়গা নাই যেখানে বাস থেমে লিচু উঠায় নাই। ঢাকা এসে আবার সেই লিচু একটু পর পর নামাচ্ছিলো।

সারাদিনের আনন্দময় ভ্রমণের শেষটা এমন হবে চিন্তাও করি নাই। তবু প্রথম সোলো ট্যুর হিসেবে এতটুকু ভুল মেনে নেওয়াই যায় তাই না…

আমার সোলো ট্যুরের সূচনা এই ট্যুরের মাধ্যমেই। সাহস করে সেদিন বের হয়ে গিয়েছিলাম বলেই আজ (৩ নভেম্বর, ২০২০) পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫১টি জেলায় যাওয়ার  সৌভাগ্য হয়েছে। যার অনেকগুলোই সোলো ট্যুর ছিলো।

Featured Image Source: google, bdnews24

শেয়ার করে বন্ধুদের জানিয়ে দিন

Similar Posts