পানিপথে লংগদু থেকে রাঙ্গামাটি – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১.২)
২০১৫ সালে ফেসবুকের এক পোস্ট থেকে জানতে পারি, পানিপথে রাঙ্গামাটি যাওয়া যায়।
রাঙ্গামাটি বলতে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলা থেকে রাঙ্গামাটি শহরে যাওয়া যায়। তখন থেকে ইচ্ছা ছিলো এই পথে একবার রাঙ্গামাটি যাবো। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রাঙ্গামাটি ঘুরে সেই ইচ্ছা আরো পক্ত হলো। কাপ্তাই লেকে ট্রলারে ঘুরে এই লেকের প্রেমে পড়ে যাই।
২০১৬ সালের আগাস্ট মাসে সাজেক যাওয়ার প্ল্যানে তাই পানিপথে রাঙ্গামাটি যাওয়াও যুক্ত করি।
দুইরাত সাজেক থেকে ২৪ আগস্ট লংগদু হয়ে রাঙ্গামাটি শহর যাবো। সকালের এসকোর্ট ১০.৩০টায় ছাড়ার কথা থাকলে কোন এক ভিআইপি আর্মির বের হতে দেরি হওয়ায় রওনা হতে হতে ১১.৩০ টার বেশি বেজে গেলো। চিন্তায় পড়ে যাই, লংগদু পৌঁছাতে না জানি কত দেরি হয়!
জীপ লংগদু পর্যন্ত রিজার্ভ নিয়েছিলাম। খাগড়াছড়ির কাছাকাছি এক জায়গায় জীপে সমস্যা হওয়ার জোরপূর্বক বিরতি দেওয়া হয়। এতে অবশ্য ভালোই হলো। সকালে কেউ নাস্তা করি নাই।
টং দোকানে কলা, পাউরুটি দেখে সবাই হামলে পড়লো। টং দোকানের পাশে বিস্কুট ফ্যাক্টরি। সদ্য বানানো বিস্কুট আর গরম বনরুটি দেখে লোভ সামলানো দায়।
মিষ্টি স্বাদের বনরুটি আর বিস্কুট দুটোই অসাধারন ছিলো। আফসোস, জায়গাটার নাম মনে নেই।
খাগড়াছড়ি থেকে লংগদুর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। লংগদু পৌছাতে ৩ টার বেশি বেজে গিয়েছে। লংগদু থেকে ট্রলারে রাঙ্গামাটি শহর যেতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে চার ঘন্টা। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় নেই। দ্রুত রওনা হতে হবে।
যাদের বেশি ক্ষুধা ছিলো তারা ট্রলার ঘাটে হোটেল থেকে ভাত, গরুর মাংস কিনলো। খাবারের পার্সেল করলো পলিথিনে। গরুর মাংস স্বাদ নাকি অসাধারন ছিলো। এখন তা রান্নার গুনে নাকি ক্ষুধার্ত পেটের গুনে তা বলা মুশকিল।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো বিকাল ৩.৩০ টায়।
প্রচন্ড রোদে সবাই ট্রলারের ছাউনিতে বসলাম। ইঞ্জিনের শব্দে বিরক্ত লাগায় আমি ট্রলারের গলুইয়ে চলে আসলাম। ইঞ্জিনের শব্দ থেকে রোদের তাপ ভালো।
একটু পরেই অবশ্য আমার এই ধারনা ভুল প্রমাণিত হলো। এমন রোদে বসে থাকা অসম্ভব। লেকের পানিতে গামছা ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে কিছুটা স্বস্তি মিললো।
যাই হোক কাপ্তাই লেক দেখে ভীষণ অবাক হলাম। মনে হচ্ছিলো কোন নদী। কাপ্তাই লেক কোন নদীর সাথে সংযুক্ত কিনা জানা নেই। যদি নদী না হয়ে লেক হয় তাহলে আসলেই এ এক বিস্ময়!
তীব্র রোদে পুড়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন সূর্য্যি মামার তেজ কমবে। আসল খেলা তো শুরু হবে তখন।
সূর্যের নিস্তেজ আলোয় কাপ্তাই লেকের যে রূপ ফুটে উঠে সে রূপ ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। লংগদু থেকে শহরে যাওয়ার পুরোটা পথই যেন স্বর্গ। ক্ষনে ক্ষনে রুপ পাল্টায়। পাহাড়ের সাথে সাথে লেকের বয়ে চলা। যে স্বচোক্ষে দেখেছে, সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। আমিও পারবো না।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আকাশে এক ধরনের আলোর সৃষ্টি হয় সে আলো দেখে মনে হবে যেন কোন রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছি। আমরা ট্রলারে নয়, রাজৈসিক বাহনে বসে আসি।
চারিদিক জুড়ে এত শান্তি, এত কোমলতা। দু চোখ ভরে দেখেও মন ভরে না। অমৃত এই সুধা তেষ্টা মেটায় না। যত পান করবো, তত তৃষ্ণা বাড়বে।
লেকের মাঝে চলতে চলতে হঠাৎ এক স্থানে এসে থমকে গেলাম। লেকের দুইপাশে বিশাল দুইটি পাহাড়। তার মাঝ দিয়ে লেক বয়ে চলছে। সামনে বাঁক থাকায় বেশিদূর দৃষ্টি যাচ্ছে না। পানিতে ৩-৪ টা নৌকা ভেসে রয়েছে। সূর্যের হলুদ আভা লেকের পানিতে পড়ছে। পুরো দৃশ্য বিশ্বাস হচ্ছিলো না। অপার্থিব লাগছিলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম, কিভাবে সম্ভব? এ আমি কি দেখছি? এত সুন্দর! এত সুন্দর! সুবহানাআল্লাহ!
অলৌকিক স্বপ্নযাত্রাকে পূর্ণতা দান করলো হঠাৎ দেখা পাওয়া পাখির ঝাঁক। দূর থেকে দেখলে মনে হয় হঠাৎ যেন আকাশ ফুঁড়ে কিছু একটা বেরিয়ে আসছে, আবার দ্রুতই মিলিয়ে যাচ্ছে। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাওয়ার সময় ক্ষনিকের জন্য তাদের দেখা মিলে। এ দৃশ্য মর্ত্যের নয়, এ দৃশ্য স্বর্গের।
রিজার্ভ বাজারের কাছে আসতে আসতে সূর্য ডুবে যায়। তবে আলোর রেশ রেখে যায়। সে আলোয় আকাশে যে বর্নীলতার সৃষ্টি হয় তা দেখার জন্য হলেও আমি আবার যাবো। বার বার যাবো। আমি কাপ্তাই লেকের প্রেমে পড়েছি। যেমনটা পড়েছিলাম ২০১২ সালে বান্দরবানের!
ভ্রমণ শপথ
- প্রকৃতিকে ভালোবাসবো, নোংরা করবো না।
- স্থানীয় মানুষদের সম্মান করবো, বিবাদে জড়াবো না।
আরো পড়ুন