ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণ – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯.১)
থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের মত আমাদের দেশেও ভাসমান বাজার রয়েছে। আমরা অনেকেই তা জানি না। পিরোজপুর জেলার আটঘর-কুড়িয়ানা ও ঝালকাঠি জেলার ভীমরুলীতে এই বাজার বসে। ভাসমান বাজার সারা বছর থাকলেও পেয়ারার মৌসুমে তা জমজমাট হয়ে উঠে।
২১ জুলাই, ২০১৬। বেড়াই বাংলাদেশের সাথে দেখতে গিয়েছিলাম ভাসমান পেয়ারা বাজার। আরো অনেক অনলাইন গ্রুপ পেয়ারা বাজার গেলেও বেড়াই বাংলাদেশের সাথে যাওয়ার কারন ছিলো কারন তাদের ২ দিনের ভ্রমণ ছিলো। সাধারনত পেয়ারা বাজার গেলে সবাই দিনে দিনে ঘুরে চলে আসে। একরাত খালের পাড়ে থাকতে পারবো এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না।
রাত ৮টার মধ্যে গ্রুপের সবাই সুরভী-৭ লঞ্চে চলে আসি। লঞ্চের দোতলার ডেকে আমাদের জন্য জায়গা দখল করে রাখা হয়। লঞ্চের ডেকে নির্দিষ্ট জায়গা বলতে কিছু নেই। চাদর দিয়ে বা যেভাবে পারে চর দখলের মত ব্যাপার স্যাপার। লঞ্চের ডেকে করে আগে কখনো যাওয়া হয় নি। বেশ মজা লাগলো বিষয়টা।
সুরভী-৭ এ উঠার সময় সেসময়কার দৈত্যকার পারাবাত-১২ লঞ্চ দেখি। আগে সেভাবে সদরঘাট আসে হয় নাই, লঞ্চেও উঠা হয় নাই। লঞ্চ বলতে জানতাম ছোট লঞ্চ যেগুলো কয়েকদিন পর পর নদীতে ডুবে। পারাবাত-১২ দেখে চক্ষু চড়কগাছ। লঞ্চটা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। লঞ্চে উঠে একটা চক্কর দিলাম। অনেক অনেক ছবি তুলে আবার আমাদের লঞ্চে চলে আসলাম।
রাত ৯টায় লঞ্চ ছেড়ে দিলো। সবাই নিজেদের মত করে আড্ডায় মেতে উঠলো। কেউ কার্ড খেলছে, কেউ গল্প করছে, কেউ লঞ্চের ছাদে চলে গেছে। আমি ঘুরে ঘুরে সবার কর্মকান্ড দেখছিলাম। আড়াইহাজার ট্রিপের মত এইখানেও আমার পরিচিত কেউ নেই। একদল অপরিচিত মানুষের সাথে যাচ্ছি ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখতে। এরচেয়ে রোমাঞ্চকর আর কি হতে পারে?
খুব ভোরে লঞ্চ বরিশাল থামলো। সাত সকালে ক্ষুধা না থাকলেও নাস্তা করে নিতে হলো কারন পথিমধ্যে দুপুরের আগে খাওয়ার সুযোগ হবে না। লঞ্চে আমাদের জন্য রান্না করা হয়েছে। গরম গরম খিচুড়ী খেয়ে লঞ্চ থেকে নামলাম।
প্রয়াত মাহমুদ ভাই আমাদের সাথে লঞ্চ ঘাটে যোগ দিলেন। মাহমুদ ভাই বরিশালেই ছিলেন। স্বরূপকাঠি যাওয়ার জন্য দুইটা বাস রিজার্ভ করা ছিলো। সবাই বাসে উঠে পড়লাম। এই বাসগুলোর সিট অনেক ছোট। বসে আরাম নেই। অনেকেই বাসের ছাদে গিয়ে বসলো। ফিরতি পথে আমিও ছাদে বসছিলাম। সে গল্প সময়মত করবো।
বাস আমাদেরকে সন্ধ্যা নদীর তীরে নামিয়ে দিলো। সেখানে দুটো ট্রলার রিজার্ভ করা ছিলো। সন্ধ্যা নদী হয়ে আমরা যাবো ব্যাকওয়াটারে যেখানে মূলত ভাসমান বাজার বসে।
ব্যাকওয়াটার কি তা ছোট করে জেনে নেওয়া যাক। ব্যাকওয়াটার হচ্ছে নদীর একটা অংশ যেখানে স্রোত তুলনামূলকভাবে অনেক কম বা নেই। ব্যাকওয়াটার প্রধান নদীর শাখা নদী হিসেবে বের হয়ে এর পাশাপাশি আলাদাভাবে বয়ে চলে পরে আবার মূল নদীর সাথে মিলে।
আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন
যদি কোন নদী উৎপত্তির সময় একাধিক গতিপথ তৈরি হয় তাহলে একটা চ্যানেল(প্রনালী) কে বলা হয় প্রধান নদী আর অন্যটিকে ব্যাকওয়াটার। প্রধান নদীর স্রোত অনেক বেশি থাকে এবং নেভিগেশন রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে ব্যাকওয়াটারে তুলনামূলকভাবে স্রোত অনেক কম থাকে এবং অগভীর হয়।
আমাদের দেশের ব্যাকওয়াটারের বরিশালের সন্ধ্যা নদী থেকে উৎপত্তি হয়। পরবর্তীতে খাল হিসেবে স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা-আটঘর, ভীমরুলী, ঝালকাঠিতে বয়ে চলেছে।
গল্পে ফিরে আসি। নদীতে সেদিন ভালোই ঢেউ ছিলো। ট্রলার বেশ দুলছিলো। সবাই দেখলাম লাইফ জ্যাকেট পড়ছে। আমি এদিকে না পারি সাঁতার, না আছে লাইফ জ্যাকেট। কিছুটা ভয় পেলাম। মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে জপতে ট্রলারের ছাদে বসলাম। মরতেই যদি হয় তাহলে আরাম করে চারপাশ দেখতে দেখতে মরি। নদী থেকে ট্রলার যখন খালে পড়লো তখন মনে স্বস্তি ফিরে আসলো। এখানে কোন ঢেউ নেই, লঞ্চের দুলনিও নেই।
ট্রলার থেকে চারিদিকের দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। কোথাও ট্রলার বা ছোট লঞ্চ বানানো হচ্ছে। নৌকা ভর্তি করে বিভিন্ন চারাগাছ নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে সিঁড়ি করে সরাসরি খালে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন এক মস্ত বড় পুকুর! ভাসমান হাসপাতাল, টিভিতে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে এবার সামনা সামনি দেখলাম। খালের সাথে লাগোয়া স্কুল। স্কুল মাঠে ছেলেপেলে খেলতেছে, হুটহাট মন চাইলেই খালের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে। নদী,খাল,মানুষ অদ্ভুত এই রসায়ন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আর এসব না দেখলে তো বাংলাদেশই দেখা হলো না!
খালের বাঁকে বাঁকে ভাসতে ভাসতে আমরা পেয়ারা বাজারের দিকে যাচ্ছি। আমাদের ভ্রমণের আনন্দকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিতেই যেন বৃষ্টির আগমন ঘটলো। চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ির মাঝে সাপের মত আঁকাবাকা খালে ভেসে আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ছোট বেলায় দেখে এনাকোন্ডা মুভির কোন দৃশ্যে আছি মনে হচ্ছিলো।
আরেকটা বিষয় খুব নজর কাড়লো। খালের পানি প্রবাহে এবং মানুষের যোগযোগ ব্যবস্থা কোনটাতেই যেন সমস্যা না হয় সেজন্য অসংখ্য ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে।
খালের পাড়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থা প্রধানত পেয়ারা, আমড়া, সুপারি, সবজী ইত্যাদির নার্সারী করে চারা গাছ বিক্রির উপর নির্ভরশীল। পুরো ক্যানেল জুড়ে তাই পেয়ারা বাগান, আমড়া বাগান এবং চারা গাছের দেখা পাওয়া যায়। পেয়ারা, আমড়ার গাছগুলো এত কাছে চাইলে ট্রলার থেকেই পেড়ে খাওয়া যায়।
ফলের বাগানগুলোতে ঢোকার জন্য পরিখা আছে । কষা নৌকা নিয়ে ঢুকে পেয়ারা পাড়া হয়। খালের সাথে যাদের আবাসস্থল তাদের প্রায় সবার কাছে অনন্ত একটা ডিংগি নৌকা রয়েছে। লোকাল ভাষায় এগুলোকে কষা নৌকা বলে। নৌকা দিয়ে বাজার, যাতায়াত সবকিছু হয়।
পেয়ারার মৌসুম হচ্ছে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যায় মাঝে মাঝে। আগস্ট মাস ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখার সবচেয়ে উপযোগী সময়। বাজার দেখতে সকাল ১১ টার মধ্যে বাজারে যেতে হবে। দিন যত বাড়ে, ভীড় তত কমতে থাকে।
আমরা ভাসমান পেয়ারা বাজারে প্রবেশ করলাম সকাল ১০টার দিকে। পেয়ারা ভর্তি করে নৌকাগুলো পানিতে ভেসে আছে। রাস্তায় ক্রেট ভর্তি পেয়ারা, ট্রাকে উঠানো হচ্ছে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু পেয়ারা আর পেয়ারা। এ এক দেখার মত দৃশ্য। একদল অপরিচিত মানুষের সাথে এতদূর পেয়ারা বাজার দেখতে আসাটা বৃথা যায় নাই।
আটঘর-কুড়িয়ানা বাজার ঘুরে আমরা ভীমরুলী চলে গেলাম। ভীমরুলীতে খালের মোহনায় বাজার বসে। চারদিক থেকে নৌকা এসে মোহনায় জড়ো হয়। ব্রিজের উপর থেকে পেয়ারা বাজারের দারুন ছবি পাওয়া যায়। ঢাকায় বসে এতদিন পেয়ারা বাজারের এমন অনেক ছবি দেখতাম। আজ নিজে তুললাম।
খালের পাশের বাজার থেকে গরম গরম মিষ্টি খেলাম। কষা নৌকায় করে ঘোরার ইচ্ছা থাকলেও উঠলাম না। সাঁতার না জানায় সাহস করতে পারি নাই। অনেকেই কষা নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরলো।
বাজার ঘুরাঘুরি শেষ। এখন গোসল করে খাওয়া দাওয়ার পালা। যেহেতু আমরা আজকে রাতে এখানেই থাকবো। তাই আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়।
পর্ব-২ঃ ভাসমান চাল বাজার, গুঠিয়া মসজিদ, দুর্গাসাগর ঘুরে দেখা