৩ দিনে ৪ জেলা ভ্রমণ – মেহেরপুর (পর্ব-১)
দেশের ৫৪ জেলায় একবার করে হলেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আর মাত্র ১০টি জেলা বাকি তাহলেই ৬৪ জেলায় যাওয়ার কোটা পূরণ হবে।
২০২২ সালের মধ্যেই এই সৌভাগ্য অর্জন করতে চাই। প্ল্যান করলাম, প্রতিটা ট্যুরে ২-৩টি করে জেলা ঘুরে দেখবো। তাহলেই কেবল ২০২২ সালে শেষ করা সম্ভব হবে।
সেই প্ল্যান মোতাবেক ঠিক হলো মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ঘুরে দেখবো।
কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রাত ১১.৩০টার মধ্যে মেহেরপুরের সব নন-এসি বাস ছেড়ে দেয়। এদিকে ভ্রমণ সঙ্গী স্কুল জীবনের বন্ধু রিজভীর অফিস শেষ করে কল্যানপুর আসতে আসতেই প্রায় ১২টা বেজে যাবে।
বেশ টান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ১১.৪০ মিনিটে কল্যানপুর গিয়ে জানতে পারলাম শ্যামলীর শেষ বাসটাও ছেড়ে চলে গেছে। তবে গাবতলীতে গিয়ে ধরার সুযোগ আছে। কাউন্টার থেকে সুপারভাইজারকে ফোন দিয়ে, টিকেট দিয়ে দিলো। কাউন্টার থেকে গাবতলী যাওয়ার জন্য সিএনজিও ঠিক করে দিলো।
সিএনজি চলছে আর এদিকে সুপারভাইজার বার বার ফোন দিচ্ছে। বাসে নিজের সিটে বসে দু’জনের মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। বিশাল এক যুদ্ধ জয় হয়েছে।
বাসে বসে আবিষ্কার করলাম আমরা কল্যানপুর না গিয়ে সরাসরি গাবতলী চলে আসলেও সমস্যা ছিলো না। এখান থেকে আরো সহজে মেহেরপুরের বাস পাওয়া যেত।
যমুনা ব্রিজ পার হয়ে বাস বিরতি দিলো। রাতের খাবার হিসেবে পরোটা, গরুর গোশত আর জিকরি ভাজি অর্ডার করলাম।
জিকরি ভাজি, মজার এক জিনিস। আমরা অর্ডার করেছিলাম সবজি ভেবে। কিন্তু আদতে এটা কুচি কুচি করে কাটা গরুর বট ও আলু ভাজি। গরম গরম খেতে কেমন লাগবে জানি না তবে আমাদের যখন দেয় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। খেতে ভালো লাগে নাই। তবে গরুর গোশতের স্বাদ বেশ ভালো ছিলো।
একেবারে শেষ মুহূর্তে বাস টিকেট করায় এইচ লাইনে সিট পাই। কুষ্টিয়ায় কয়েকজন যাত্রী নেমে গেলে সি লাইনে গিয়ে বসলাম। এবং এটা ছিলো আমাদের জন্য এক আশির্বাদ। কেনো তা বলছি।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত প্রায় পুরো রাস্তা জঘন্য রকমের ভাঙ্গা। কোন হাইওয়ে রাস্তার অবস্থা এমন হতে পারে ২০২২ সালে এসে তা চিন্তাও করা না!
সকাল ৭.১৭ মিনিটে বাস আমাদের মেহেরপুর নামিয়ে দিলো। ৫৫ নাম্বার জেলার ধুলো পায়ে জড়ালো।
রিজভীর চা পান শেষে আমরা গেলাম বাসুদেব মিষ্টান্ন ভান্ডারে, মেহেরপুরের বিখ্যাত সাবিত্রী মিষ্টি খাওয়ার জন্য।
সাবিত্রীর নাম প্রথম শুনি সম্ভবত ২০১৭ সালে।
মেহেরপুর গিয়ে এর স্বাদ না নিলে মেহেরপুর ভ্রমণ বৃথা টাইপ ব্যাপার স্যাপার।
দোকান খোলা দেখে আশ্বস্ত হলাম যে মিষ্টি পাওয়া যাবে। এত সকালে নিশ্চয়ই মিষ্টি শেষ হয়ে যাবে না। ভিতরে ঢুকে শুনি, মিষ্টি তখনো তৈরি হয় নাই। ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগবে।
বললাম, অপেক্ষা করি।
দোকানে থাকা লোকটি বললো অপেক্ষা করার দরকার নেই। আপনাদের কাজ থাকলে চলে যাওয়াই ভালো। মিষ্টি হলেও দিতে পারবো নাকি নিশ্চিত নই।
বললাম, মিষ্টি খাওয়াই কাজ। এজন্যই মেহেরপুরে এসেছি।
আমাদের উৎসাহ দমাতে পারে নাই দেখে লোকটি বেশ বিষণ্ণ হলো।
বেশ কিছু সময় দোকানের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে, ছবি তুলে, হেঁটে হেঁটে বড় বাজার মোড়ে গিয়াস মিষ্টান্ন ভান্ডারে চলে গেলাম।
চেখে দেখলাম চমচম, কালো জাম, ছানার মিষ্টি। সবগুলোর স্বাদই ভালো। ওদের কালো জামটা ভিন্ন ভাবে তৈরি। এমন কালো জাম আগে কোথাও খাওয়া হয় নাই।
মিষ্টি খাওয়া শেষে এবার রিকশা নিলাম। দ্রুত বাসুদেবে যেতে হবে।
৪০ মিনিট পর আবার বাসুদেবে ঢুকলাম।
আমাদের দেখে দোকানী অবাক হলো। ভেবেছিলো চলে গিয়েছি।
আমি হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, মিষ্টি কি পাওয়া যাবে? তৈরি হয়েছে।
দোকানী বুঝলো এই নাছোড়বান্দারা মিষ্টি না খাওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না। টিস্যুতে পেঁচিয়ে দুইজনকে দুইটা সাবিত্রী দিলো।
মুখে দিয়ে মনে মনে বললাম, স্বার্থক। যে নাম-ডাক শুনে এই মিষ্টি খেতে এসেছি তা ঠিক আছে। এই মিষ্টি খাওয়ার জন্য এতটুকু ‘যন্ত্রণা’ ভোগ করাই যায়।
আগের চেয়েও দ্বিগুন হাসিমুখে বললাম, আরেকটা মিষ্টি পাওয়া যাবে?
এনে দিলো।
তৃপ্তি নিয়ে খেলাম।
শুরু হলো মেহেরপুর ভ্রমণ…
আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন
মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রথমে অটোতে আমঝুপি বাজার। বাজার থেকে আরেক অটোতে নীলকুঠি।
মেহেরপুরের অটো ভাড়া তুলনামূলক বেশি মনে হলো। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে সমপরিমান ভাড়ায় আরো বেশি দূরত্বে যাওয়া যায়।
সে যাই হোক নীলকুঠির সামনে এসে ধরা খেলাম। মূল ভবনের গেট খুলবে আরো প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর। এত সময় এখানে অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যেতে হবে বহুদূর।
৭৭ একরের বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত নীলকুঠি কমপ্লেক্স। মূলভবনে প্রবেশ করতে না পারলেও আশেপাশে ঘুরে দেখতে কোন বাঁধা নেই।
নীলকুঠির পাশ দিয়ে বয়ে চলছে কাজলা নদী৷ দেশের অন্যান্য নদীর মত এই নদীর অবস্থাও সঙ্গীন। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা নদী।
নদীর ধারে পাট শুকানো হচ্ছে। সাথে ধইঞ্চ্যার কাঠি। কোনটা পাট, কোনটা ধইঞ্চ্যা আমার মত অজ্ঞ তা চিনতে না পারলেও অভিজ্ঞ রিজভী চিনিয়ে দিলো।
নদীর পাড়ে আরো দেখা মিললো নানা প্রজাতির পাখির; শালিক, দোয়েল, ঘুঘু, ফিঙে। সুনসান নিরবতায় পাখির ডাকে ঘোর ঘোর লাগে। ইচ্ছে হচ্ছিলো, নদীর পাড়ে মাঁচা বানিয়ে শুয়ে-বসে দিন কাটিয়ে দেই। হয়তো কোনদিন হবে, হয়তো…
নীলকুঠির বাগানে রয়েছে আম গাছ, সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, সুবিধাল কড়ই সহ আরো নানা প্রজাতির গাছ।
বাবুই পাখির বাসা, বিশাল কড়ই গাছে টিয়া পাখির দেখা মিললো।
অনেক বছর পর এক ঝাঁক মুক্ত টিয়া পাখি দেখলাম। ছোট বেলায় ঢাকার মিরপুরে আমাদের বাসার ছাদ থেকেই টিয়া পাখি দেখা যেত। প্রায় বিকেলে দেখতাম ঝাঁক বেঁধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাচ্ছে। এখন আর দেখা যায় না।
এবার যাবো মুজিবনগর।
মুজিবনগর বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই উপজেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে বিভিন্নভাবে ৯টি ঘটনা/বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সেখানের এক জৌষ্ঠ ব্যক্তি যে মূলত স্মৃতিসৌধের দেখাশোনা করেন তিনি পুরোটাই মুখস্ত বলছিলেন। সাথে কোনটা কোথায় আছে তা হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলেন।
আমাদের কাছে এসে যখন নিজ থেকে ইতিহাস বলা শুরু করলেন তখন কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিলো যে, কোন ধরনের অর্থ প্রাপ্তির আশা ব্যতীত শুধু পর্যটকের জ্ঞান বৃদ্ধির খাতিরে তিনি সঙ্গ দিচ্ছেন না। তবু মনে মনে নিজেকে বোঝালাম, ইতিহাস প্রেমী মানুষ তো থাকতেই পারে। যিনি চান মানুষ শুধু স্মৃতিসৌধের সাথে সেলফি না তুলে, স্মৃতিসৌধের খুঁটিনাটিগুলোও জানুক।
শেষতক, আমার ধারনা সত্য হলো। অর্থপ্রাপ্তির আশাই এই জ্ঞান বিতরণের মূল কারন।
যে তথ্য তিনি আমাদের মুখে বলছিলেন তা ফলকেই লেখা আছে। তবু তার মুখ থেকে শুনতে খারাপ লাগছিলো না।
স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পর উদর পূর্তি করার বাসনায় চটপটি খেতে বসলাম। স্বাদ তেমন ভালো না, তবু এমন পরিবেশে এক প্লেট খাওয়াই যায়।
মুজিবনগরে রয়েছে বাংলাদেশের বিশাল এক মানচিত্র। এই মানচিত্রের ছবি ফেসবুকসহ নেটে কতবার দেখেছি। আজ তা চোখের সামনে।
ছবিতে দেখা কোন জায়গা,
স্বশরীরে, স্বচোখে দেখার আনন্দ
তুলনাহীন!
এমন বিশাল মানচিত্র ঢাকার জাতীয় জাদুঘরেও রয়েছে। সেখানে মানচিত্রে বিভিন্ন জেলা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর এখানে মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মানচিত্র দেখার সুবিধার্থে চারিদিকে টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ার থেকে ঘুরে ঘুরে মানচিত্র দেখলাম। আরো দেখলাম দিগন্ত বিস্তৃত আম্রকানন ও সবুজ মাঠ।
ঢাকায় ইট-পাথরের জঞ্জাল থেকে বেড়িয়ে যখন এমন মুক্ত খোলা মাঠ দেখি বুকের ভিতর হু হু করে উঠে।
পুরো মুজিবনগর যখন হেঁটে ঘোরা প্রায় শেষ তখন এক ভ্যান মামা এসে হাজির। বললো পুরো মুজিব কমপ্লেক্স ঘুরিয়ে দেখাবে, আরো দেখাবে স্বাধীনতা সড়ক বর্ডার (বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত)।
মুজিবনগর ইতিমধ্যে ঘুরেছি কিন্তু স্বাধীনতা সড়ক বর্ডার আগ্রহ জাগালো। ভ্যানে চড়ে বসলাম।
ব্যাটারি চালিত ভ্যানের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে মামার মুখের কথা ছুটতেছে। ইতিমধ্যে দেখা জিনিস সে পুনরায় দেখাচ্ছিলো আর এটাও একটা দেখার স্পট বলে গণনা করছিলো।
মুজিবনগরে নিয়মিত পর্যটক ঘুরিয়ে অভ্যস্ত বোঝা গেলো। এবং সেই সাথে এও বুঝে নিলাম, যে ভাড়া নির্ধারন করেছি তাতে ‘চুনা’ খেয়ে গেছি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দেখলাম। এখনো রাস্তা পুরো পাকা করা হয় নাই। বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে লেখা আছে, প্রবেশ নিষেধ।
এক পৃথিবী, এক মানুষ, তবু কত বিভাজন!
বাংলাদেশ-ভারত সবগুলো বর্ডার এরিয়া ভ্রমণের ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। জানি না কোনদিন তা পূরণ হবে কিনা।
সীমান্তে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর৷ ভারতের অংশে কোন মানুষের দেখা না পেলেও কয়েকটা গরু দেখা গেলো।
বর্ডার দর্শন শেষে ভ্যান আমাদের কেদারগঞ্জ বাজার নামিয়ে দিলো। মেহেরপুর ভ্রমণের ইতি টেনে এবার রওনা হলাম চুয়াডাঙ্গা…
- পর্ব-২ঃ চুয়াডাঙ্গা দর্শন
- পর্ব-৩ঃ ঝিনাইদহ ভ্রমণ
- পর্ব-৪(শেষ পর্ব): নড়াইল দর্শন
Never lose hope, never stop travelling