স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর
গত ১০ই আগস্ট, বুধবার একটা কাজে নীলক্ষেত যেতে হয়। কাজ শেষ হতে সময় লাগবে দেখে প্রথমে গেলাম গাউসুল আজমের পাশের গলির মামা হোটেলে। দুপুর হয়ে যাওয়ায় ভালোই ক্ষুধা ছিলো।
মামা হোটেলের পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে বানানো সালাদটা আমার অনেক পছন্দ। ভরপুর বৃষ্টি থাকায় ভাতের সাথে নিলাম আস্ত ইলিশ। ভাত, আস্ত ইলিশ, আলু ভর্তা, ডাল…বেহেস্তী খাবার খেয়ে বের হয়ে চিন্তা করলাম এখন কি করবো!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা মন্দির আছে। মন্দিরের পাশেই আছে একটা পুকুর। যদিও কচুরিপানা দিয়ে ভরা। জায়গাটা বেশ পছন্দ কোন এক কারনে,নিজেও জানি না কি কারন! আর এমনিতে পছন্দ হওয়ার মত তেমন কিছু নেইও। যাই হোক প্রথমে পুকুর পাড়ে গেলাম। কিছুক্ষন ঘুরে ভাবলাম যাই স্বাধীনতা স্তম্ভের লেকের পাশে বেঞ্চে বসে থাকি।
পুকুরপাড় থেকে স্বাধীনতা স্তম্ভের কাছে যেতে একটা মাঠ পাড়ি দিতে হয়। বৃষ্টি হওয়ায় মাঠ কাঁদায় ভরপুর। বেশ কয়েকবার পিছলা খেয়ে, প্যান্টে কাঁদা মেখে লেকের পাশে চলে আসলাম। ততক্ষনে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
বৃষ্টির মধ্যে লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে মনেই হচ্ছিলো না আমি ঢাকায় আছি। এ যেন অন্য কোন স্থান। দূরে মাঠের মধ্যে একদল ছেলে ফুটবল খেলছে। লেকের পাশের বেঞ্চিগুলোতে কাপল, বন্ধু-বান্ধব বসে আছে। কেউ কেউ ছাতা মাথায় কেউবা বৃষ্টির স্বাদ নিচ্ছে। আশেপাশে কোন ইট-পাথরের দালান নেই। মুক্ত খোলা আকাশ দেখে মনও মুক্ত হয়ে উঠে। সাথে একদল পিচ্চির দস্যিপনা দেখে মন আরো উথাল পাথাল করে উঠলো।
অগভীর জলে, পাড়ে দাঁড়িয়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে গোসল করা। পৃথিবীর সকল সুখ যেন এর মাঝেই নিহিত। এর মধ্যেই এক ফটোগ্রাফার ভাই পলিথিনে ক্যামেরা মুড়িয়ে এসে ওদের বললো পোজ দাও তো পোলাপান। আর যায় কোথায়, যে যেভাবে পারে লাফিয়ে ঝাপিয়ে পোজ দিতে থাকলো। সুখ লাগে এসব দৃশ্য দেখলে।
আমি এদিকে বৃষ্টিস্নাত হতে থাকলাম। ভিজে চুপচুপা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ভীষন আনন্দ হচ্ছে। ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছিলাম যেন। এ অনুভূতি ভাষায় বোঝানোর মত নয়।
বৃষ্টিস্লান শেষে উদ্যান থেকে বের হতে যাবো তখন মাথায় আসলো এখানেই তো একটা জাদুঘর আছে মাটির নিচে। এক গার্ড ভাইকে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, এই স্তম্ভের নিচেই তো জাদুঘর। আর কি! শুনেই জাদুঘরে দেখতে হাঁটা দিলাম।
টিকেট কেটে জাদুঘরে ঢুকতেই একটা বিশাল লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। পাতালে ঢুকে পড়ছি এমন মনে হচ্ছিলো। পাতালে ঢুকা যেখানে শেষ হয় সেখানেই অডিও/ভিজুয়াল রুম। বিভিন্ন সময় এখানে মুভি দেখানো হয়।
আরেকটু ভিতরে ঢুকে তো থ! বিশাল ব্যাপার স্যাপার।আরেক ফ্লোর নিচে বিশাল জায়গা। ফাঁকা জায়গার মাঝে মাঝে সুন্দর করে সাজানো বিভিন্ন সময়ের ছবি। বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বাংলাদেশের মানচিত্র, যুদ্ধের ছবি, ৭ই মার্চের ভাষনের ছবি, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষরের সময়কার ছবি…
ভিতরে একটি ফোয়ারাও রয়েছে যেটা মাটির উপর থেকে এসেছে। পুরো জায়গাটাই দেখতে অনেক সুন্দর। ছবিগুলো দেখেও ভালো লাগছিলো।
ধাক্কা খাই কালো রঙের দেয়ালের একটা গ্যালারিতে এসে। যুদ্ধের সময়কার ছবিগুলো দেখে শিউরিয়ে উঠি। কংকালের সব ছবি। দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। আমি স্বাধীন। আমাদের দেশ স্বাধীন।
আমাকে মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে দেখে ওখানকার এক লোক বললো, ডিএসএলআর নিয়ে আসবেন। এখনো এখানে ছবি তুলতে দেওয়া হয়। কবে বন্ধ করে দিবে তার কোন ঠিক নেই। এরমধ্যে এসে তুলে যাবেন। আরো জানালো মাটির নিচে আরো দুইতলা নাকি করা হচ্ছে। সেখানে ঢুকতে তিনি নিজেও ভয় পান। এখন নিচে যাওয়া নিষেধ তাও নাকি অনেকে না বলে ঢুকে পড়ে। বলতেছিলো নিচে এমন জায়গা হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না!
জাদুঘরের ভিতরকার আলোর খেলাও বেশ ভাল্লাগলো। বাইরের আলো ভিতরে প্রবেশ করছিলো। একপথ দিয়ে ঢুকে ঘুরা শেষে অন্যপথ দিয়ে বের হয়ে আসলাম।
জাদুঘর থেকে বের হয়েই আরেকটু সামনে দেখলাম আগুন জ্বলজ্বল করছে। কি ব্যাপার দেখতে সামনে এগিয়ে গেলাম। বাঙ্গালী জাতিসত্তার অমরতার প্রতীক “শিখা চিরন্তন” জ্বলছে। কিছু নেই এমনিতেই আগুন জ্বলতেছে। দেখে আজবই মনে হচ্ছিলো।
স্বাধীনতা জাদুঘর যে উন্মুক্ত করা হয়েছে দর্শকদের জন্য এটা এখনো অনেকে জানে না। গত বছর স্বাধীনতা দিবস(২৬ই মার্চ, ২০১৫) এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দেশের ইতিহাস জানার জন্য এখানে অবশ্যই আসা উচিত। আলোকচিত্রগুলো দেখে বুকের ভিতর কিছুটা হলেও নাড়া দিয়ে উঠবে!!!
কিভাবে যাবেন
ঢাকার যেকোন জায়গা থেকে প্রথমে শাহবাগ মোড়ে আসবেন। শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি এর দিকে আগাতে থাকলে কিছুক্ষনে পরেই হাতের বামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকার গেট পাবেন। ভিতরে ঢুকলেই স্বাধীনতা স্তম্ভ দেখতে পাবেন। না হলে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দিবে।