ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণ গাইড (২০২৪) [খরচ, থাকা, খাওয়া, যাতায়াত সব তথ্য]
থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট দেখে আমরা যারা হা-হুতাশ করি তাদের জন্য সুখবর হচ্ছে আমাদের দেশেও ভাসমান বাজার রয়েছে। আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলীতে প্রধানত বাজার বসে। খালের মোহনায় বাজার হওয়ায় তিনদিক থেকে নৌকা দিয়ে এসে এখানে বেচাকেনা চলে। ভাসমান পেয়ারা বাজার(Floating Guava Market) নামে জনপ্রিয় হলেও সব মৌসুমেই ভাসমান বাজার চলে।
কি কি খাবেন
- ভীমরুলি বাজারে সাদা মিষ্টি, লাল মিষ্টি
- কুড়িয়ানা বাজারে বৌদির হোটেলে দুপুরের খাবার
- কুড়িয়ানা বাজারে ঋতুপর্ণা দোকানের গরম মিষ্টি
- গুঠিয়ার সন্দেশ
বরিশাল শহরে
- হক এর রসমালাই, রসগোল্লা,ছানা, পুরান বাজার এলাকা
- শশীর রসমালাই, বটতলা এলাকা
- নিতাইর মিষ্টি মুখে দিলেই গলে যায়, নুতন বাজার এলাকা
- দধি ঘোরের দই, ঘোল, ঘোল-মুড়ি মিক্সড, বিবির পুকুর পাড় থেকে একটু সামনে
- বিবির পুকুর পাড়ের চটপটি
থাকার ব্যবস্থা
ভাসমান পেয়ারা বাজারের ওইখানে রাত্রিযাপন করতে চাইলে ঝালকাঠি শহরে কয়েকটি হোটেল আছে। কালিবাড়ি রোডে ধানসিঁড়ি রেস্ট হাউস, বাতাসা পট্টিতে আরাফাত বোর্ডিং, সদর রোডে হালিমা বোর্ডিং ইত্যাদি। ভাড়া ১০০ থেকে ২৫০ টাকা।
ভালো মানের হোটেলে থাকতে হলে বরিশাল আসতে হবে। বরিশাল শহরে অনেক ভালো মানের হোটেল রয়েছে। হোটেল গ্র্যান্ড পার্ক, হোটেল এরিনা ইত্যাদি।
ভাসমান পেয়ারা বাজার যাওয়ার উপায়
বরিশাল দুই পথে যাওয়া যায়। পানিপথ অথবা সড়কপথ।
লঞ্চে গেলে
প্রতিদিন রাত ৮.৩০-৯.৩০ টার মধ্যে অনেক লঞ্চ ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। পৌঁছাবেন ভোর ৪-৫ টায়। বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে অটোতে করে চৌরাস্তায় এসে স্বরূপকাঠিগামী বাসে উঠবেন। স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাট পর্যন্ত ভাড়া ৫০-৭০ টাকা নিবে।
হুলারহাটের লঞ্চে করে সরাসরি স্বরূপকাঠি যেতে পারবেন। তবে এই লঞ্চগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট, আস্তে চলে আর অনেক আগে ছাড়ে। তাই বরিশাল হয়ে যাওয়া ভালো। বরিশাল থেকে স্বরূপকাঠি যাওয়ার রাস্তাটাও সুন্দর।
এখান থেকে কয়েকভাবে যাওয়া যায়
স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া করে সন্ধ্যা নদী দেখতে দেখতে ছোট ছোট ক্যানেলে ঢুকা। আটঘর,কুড়িয়ানা,ভীমরুলী বাজার ঘুরে দেখা। ট্রলার ভাড়া দামাদামি করে নিতে হবে। ট্রলারভেদে ১০০০-২০০০ এর মধ্যে হয়ে যাবে।
অথবা স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাট থেকে অটোতে করে কুড়িয়ানা বাজার। ভাড়া ১৮-২৫ টাকা। সেখান থেকে নৌকা/ট্রলার ভাড়া করে শুধু কুড়িয়ানার আশপাশের বাজার আর ক্যানেল ঘুরলে ২০০-৪০০ টাকা দিলেই হবে। ছোট ডিঙ্গি নৌকা। ভীমরুলী পর্যন্ত গেলে ভাড়া বেশি পড়বে।
অথবা অটোতে করে আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলী বাজার ঘোরা। কিছু কিছু ব্রিজ ভাঙ্গা থাকায় সম্পূর্ণ রাস্তা অটোতে যাওয়া যাবে না। হেঁটে পার হয়ে আবার অটো নিতে হবে। তবে আশপাশ দেখতে দেখতে হাঁটতে খারাপ লাগবে না। আমার মতে নৌকা/ট্রলারে ভাসমান পেয়ারা বাজার ঘোরা সবচেয়ে উত্তম।
বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে চৌরাস্তা। সেখান থেকে টেম্পুর মত একধরনের গাড়ি আছে। সেটাতে করে কুড়িয়ানা স্কুল। ভাড়া ৩০-৫০ টাকা। স্কুল থেকে কুড়িয়ানা বাজার হাঁটা পথে ১.৫-২ কিলোর মত। হাঁটতে ভালো লাগবে। না হাঁটলে অটো বা রিকশা করে কুড়িয়ানা বাজার। সেখান থেকে খালের পাড় থেকে নৌকা/ট্রলার ভাড়া করে ঘুরে বেড়ানো।
বাসে গেলে
গাবতলী, আরামবাগ, সায়েদাবাদ থেকে এসি/নন-এসি অনেক বাস বরিশাল যায়।
গ্রীণ লাইন, শ্যামলী, হানিফ, সেন্টমার্টিন ট্রাভেলস, সাকুরা, ঈগল ইত্যাদি
নন-এসি বাস ভাড়া ৪৫০ টাকার মত। এসি বাস ৬৫০-১০০০ টাকা ক্লাস ভেদে।
স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাটের সরাসরি বাসও রয়েছে। গাবতলী থেকে সোনার তরী, সাকুরা, হানিফ বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫০০-৭০০ টাকা।
বরিশাল বা স্বরূপকাঠি যেখানেই আসেন সেখান থেকে কুড়িয়ানা যাওয়ার উপায় উপরেই দেওয়া আছে।
বাসের চেয়ে লঞ্চ জার্নি বেশি আরামদায়ক।
লঞ্চের ভাড়া
ডেক-২৫০
সিঙ্গেল কেবিন – ১৪০০
ডাবল কেবিন – ১৮০০
বাস এবং লঞ্চের ভাড়া তারতম্য হতে পারে। তাই যখন যাবেন আপডেটেড ভাড়া জেনে নিবেন।
ভাসমান পেয়ারা বাজার ট্যুর প্ল্যান-১
সকালে বরিশাল বা স্বরূপকাঠি এসে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে ব্যাকওয়াটার ও ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণ। দুপুরে কুড়িয়ানা বাজারে বৌদির হোটেল খাবার খেয়ে বাসে উঠে বানারীপাড়া গুঠিয়া মসজিদে চলে আসা। গুঠিয়া মসজিদের ওইখানে সন্দেশ পাওয়া যায়, সন্দেশ খেয়ে দুর্গাসাগর আসা। গুঠিয়া মসজিদ থেকে বেশি দূরে না। দূর্গাসাগরের ১.৬ কিলোমিটার ট্রেইল হেঁটে, দূর্গাসাগরের পাড়ে বসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করে বাসে বরিশাল শহর চলে আসা। হাতে সময় থাকলে বিবির পুকুর পাড়ে সন্ধ্যা বেলার জমাট আড্ডা আর চটপটি খেয়ে লঞ্চে/বাসে উঠে ঢাকা।
ভাসমান পেয়ারা বাজার ট্যুর প্ল্যান-২
সকালে বরিশাল বা স্বরূপকাঠি এসে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে ব্যাকওয়াটার ও ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণ। দুপুরে কুড়িয়ানা বাজারে বৌদির হোটেল খাবার খেয়ে আবার ব্যাকওয়াটার ভ্রমণ। এরপর ঝালকাঠিতে হোটেলে রাত্রিযাপন। এরপর সকালে ঝালকাঠি ঘুরাঘুরি করে গুঠিয়া মসজিদ, দুর্গাসাগর ঘুরে বরিশাল শহরে আসা। বরিশাল শহর ঘুরে লঞ্চে করে ঢাকা।
গুঠিয়া মসজিদের দর্শনার্থী সময়সূচি
১২.৩০ থেকে ২ টা (শুক্রবার ১২ থেকে ২ টা)
৪.৩০ থেকে ৮ টা
কিছু পরামর্শ
- গ্রুপ করে গেলে ভালো
- বাসের থেকে লঞ্চ জার্নি ভালো
- মিষ্টি অবশ্যই খাবেন
- পানিতে কোন ময়লা ফেলবেন না
ব্যাকওয়াটার কি?
ব্যাকওয়াটার হচ্ছে নদীর একটা অংশ যেখানে স্রোত তুলনামূলকভাবে অনেক কম বা নেই। ব্যাকওয়াটার প্রধান নদীর শাখা নদী হিসেবে বের হয়ে এর পাশাপাশি আলাদাভাবে বয়ে চলে পরে আবার মূল নদীর সাথে মিলে।
যদি কোন নদী উৎপত্তির সময় একাধিক গতিপথ তৈরি হয় তাহলে একটা চ্যানেল(প্রনালী) কে বলা হয় প্রধান নদী আর অন্যটিকে ব্যাকওয়াটার। প্রধান নদীর স্রোত অনেক বেশি থাকে এবং নেভিগেশন রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে ব্যাকওয়াটারে তুলনামূলকভাবে স্রোত অনেক কম এবং অগভীর হয়।
আমাদের দেশেও ব্যাকওয়াটার রয়েছে। বরিশালের সন্ধ্যা নদী থেকে যার উৎপত্তি। পরবর্তীতে ছোট খাল হিসেবে স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর, ভীমরুলী, ঝালকাঠিতে বয়ে চলেছে। খালের পাশেই রয়েছে জনপদ। স্কুল, রাস্তা, বাসাবাড়ি সব খালের দুই পাড়েই অবস্থিত। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য রয়েছে ব্রিজ। খালের পানি প্রবাহে যেন কোন সমস্যা না হয় তাই তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য ব্রিজ।
দিনে দুইবার জোয়ার ভাটায় পানি দুই ফুটের মত উঠা নামা করে। খালের পাশে যাদের বাড়ি জোয়ারের সময় তাদের উঠান পর্যন্ত পানি উঠে। তবে তা তে কোন সমস্যা হয় না। বড় বড় বন্যার সময়ও এখানে পানি খুব বেশি উচুঁতে উঠে না।
খালের পাড়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থা প্রধানত পেয়ারা, আমড়া, সুপারি, সবজী ইত্যাদির নার্সারী করে চারা গাছ বিক্রির উপর নির্ভরশীল। পুরো ক্যানেল জুড়েই পেয়ারা বাগান, আমড়া বাগান এবং চারা গাছের দেখা পাওয়া যায়। বাগানে ঢুকার জন্য রয়েছে পরিখার মত। ছোট বা কষা নৌকা নিয়ে সেখানে ঢুকে পেয়ারা পাড়া হয়। খালের সাথে যাদের আবাসস্থল তাদের প্রায় সবার কাছে অনন্ত একটা ডিংগি নৌকা রয়েছে। লোকাল ভাষায় এগুলোকে কষা নৌকা বলা হয়। নৌকা দিয়ে বাজার, যাতায়াত সবকিছু করা হয়।
পেয়ারার মৌসুম হচ্ছে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যায় মাঝে মাঝে। আগস্ট মাস ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখার সবচেয়ে উপযোগী সময়। বাজার দেখতে সকাল ১১ টার মধ্যে বাজারে যেতে হবে। দিন যত বাড়ে, ভীড় তত কমতে থাকে।
ব্যাকওয়াটারে ঘুরার প্রধান মজা হচ্ছে এর আশেপাশের দৃশ্য। খালের সাথে লাগোয়া বাড়ি, স্কুল, রাস্তা, ব্রিজ সারাক্ষন সম্মোহিত করে রাখে। খালের মধ্যে বাঁক নিয়ে বয়ে চলা পানিপথে ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে এযেন অন্য কোন জগত। সাথে যদি বৃষ্টি থাকে তাহলে তো কোন কথাই নেই। ট্রলারের ছাদ/নৌকায় বসে ভিজতে ভিজতে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পুরো খাল জুড়ে সবুজের ছড়াছড়ি। বর্ষাকাল হওয়ায় আকাশেও থাকে মেঘেদের খেলা।
খালের সাথের পেয়ারা বা আমড়া গাছ থেকে ট্রলারের ছাদ থেকেই পেয়ারা ছিঁড়ে খাওয়া। ছোট নৌকা হলে ঢুকে পড়া যায় বাগানের মাঝের পরিখাগুলোতে। আর বড় ট্রলার হলে পাড়ে নেমে বাগানে হেঁটে বেড়ানো। অসাধারন ভালোলাগার সব অনুভূতি। নতুন এক স্বাদযুক্ত হবে ভ্রমনে। (বাগান মালিকের অনুমতি ব্যতিত পেয়ারা বা আমড়া ছিঁড়ে খাবেন না)
সন্ধ্যের আধাঁরীতে খালের মাঝে বয়ে চলা দিবে গা শিরশিরে অনুভূতি। অস্পষ্ট পথ ধরে দক্ষ মাঝির বয়ে চলা। আকাশে ততক্ষনে তারাদের মেলা বসেছে। মেঘের আড়ালে ক্ষনিক পর পর উঁকি দিচ্ছে স্পতর্ষী। ট্রলারের ছাদে শুয়ে সেই আকাশ দেখতে দেখতে বাঁচতে ইচ্ছে হবে আরো বহু বছর।
কুড়িয়ানা ছোট বাজার হলেও দুপুরে তার একরূপ, সন্ধ্যেতে আরেক রূপ। বাজারের ঋতুপর্ণা দোকানের রসগোল্লা না খেলে হবে চরম মিস। গরম গরম মিষ্টিরই স্বাদ যেন অমৃত। দুপুরে খেতে হবে বৌদির হোটেলে। সে আরেক অমৃত সুধা।
বাজার ঘুরে বরিশাল আসার পথে গুঠিয়া মসজিদ পড়বে। অসম্ভব সুন্দর মসজিদ। সবচেয়ে ভালো লেগেছে এর অবস্থান। মসজিদের পিছেই মুক্ত বিশাল আকাশ। দেখতে বড্ড ভালো লাগে। বৃষ্টির মাঝে মসজিদের পুকুরে গোসল করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। উপরে হিম শীতল বৃষ্টির ফোঁঁটা আর নিচে পুকুরের গরম পানি। সন্ধ্যের আলোতে আরেক রুপ নিয়ে হাজির হয় মসজিদটি।
গুঠিয়া মসজিদ থেকে কিছুদূরে দুর্গাসাগর। দুর্গাসাগরে প্রায় দুই ঘন্টা গোসল করে শরীর পুড়ো চাঙ্গা হয়ে উঠে। এরপর ১.৬ কিলোমিটার ট্রেইল হাঁটতে বের হই। পুরো দীঘিকে ঘিরে এই ট্রেইল, হাঁটতে ভালোই লাগে। মজার ব্যাপার হলো পুকুরের মাঝে একটা ছোটখাট দ্বীপও রয়েছে। যদিও সাপদের আস্তানা। সব ঘুরে বরিশাল ফিরে ঢাকার লঞ্চ চড়ে বসা।
প্রয়াত Mahmud Hasan Khan ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাসমান এই বাজারকে সাধারন মানুষসহ দেশের বাইরের অনেক পর্যটকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
আরো পড়ুন