ঝড় দেখতে কক্সবাজার, ছিলাম মাত্র ৩ ঘন্টা – ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭)
২০ মে, ২০১৬ বিকাল। টিভিতে উপকূলীয় এলাকায় ৭ নাম্বার বিপদ সংকেত দেখে আম্মুকে বললাম, ইশ! এখন কক্সবাজার থাকতে পারলে কত ভালো হতো। সমুদ্রের পাড়ে বসে ঝড় দেখা যেতো। আম্মু আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো, কিছু বললো না। আমার পাগলামি সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট ধারনা আছে। কি থেকে কি বলবে দেখবে সত্যিই আমি ঝড় দেখতে যাচ্ছি!
ঝড় দেখতে পারবো না এই শোকে ছাদে গেলাম। আকাশ জুড়ে কালো মেঘেদের খেলা দেখবো। ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম কয়েকজন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ঝড়ে আটকা পড়েছে। তারা ঝড়ের ছবি পোস্ট করতেছে। আরো অনেকেই এখন কক্সবাজারে আছে। তারাও ছবি পোস্ট করতেছে।
ছবি দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। ঠিক করলাম কক্সবাজার যাবো। আমার সাথে স্কুলের বন্ধু রুপু ছিলো। ওকে কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলতে রাজি হয়ে গেলো। সাথে সাথে চট্টগ্রামে থাকা আরেক স্কুল বন্ধুকে ফোন দিলাম। কক্সবাজার যাওয়ার কথা শুনে রিজভীও রাজি।
টাকা-পয়সার হিসাব করতে বসলাম। পকেটের অবস্থা খুব একটা ভালো না। কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করে বের করলাম যাওয়ার সময় ১২০ টাকায় মেইল ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবো। সেখান থেকে বাসে ২০০-২৫০ টাকায় কক্সবাজার। কক্সবাজারে যেহেতু থাকবো না খরচ বেশি হবে না।
কক্সবাজার যাচ্ছি নিশ্চিত। রুপু ব্যাগ গুছাতে বাসায় চলে গেলো। আমিও নিচে নেমে ব্যাগ গুছানো শুরু করলাম। আম্মুকে কক্সবাজার যাচ্ছি বলার পর এবারও কিছু বললো না। সম্ভবত আগেই বুঝে গেছিলো এমন কিছু একটা হবে।
রাত ৯ টায় কমলাপুরে গিয়ে মেইল ট্রেনের টিকেট কাটলাম। মেইল ট্রেনে কোন সিট নাম্বার থাকে না। সিট দখল করতে হয়। আমরাও সিট দখল করে বসলাম। মেইল ট্রেনে উঠার একটা মজা আছে এখানে হরেক রকম মানুষের দেখা পাওয়া যায়। নানা মানুষের নানা কাহিনী দেখতে দেখতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছিলো।
আমার লেখা ই-বুক কিনতে এখানে ক্লিক করুন
সকাল ৭.৪৫ মিনিটে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে চট্টগ্রাম নামলাম। রেলস্টেশন থেকে বাসে করে বদ্দার হাট গেলাম। বদ্দার হাটে রিজভীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে আসছি কিন্তু রিজভী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদ্দার হাট আসতে পারে নাই। ওর দেরি নিয়ে অভিযোগ করার কারনে আমাদের দুইজনকে একচোট মার খেতে হলো।
দামাদামি করে ২৫০ টাকার হানিফ বাসের টিকেট ২২০ টাকা দিয়ে নিলাম। টিকেট কেটে নাস্তা করতে চলে গেলাম। ৯.৩০ মিনিটে বাস ছাড়লো।
বাস ছাড়ার পর বুঝতে পারলাম কত বড় ভুল করছি। চট্টগ্রাম থেকে এই বাসগুলো যে লোকাল যায় জানা ছিলো না। রাস্তায় এমন কোন জায়গা নাই যেখানে থামায় নাই। ড্রাইভারও তেমন দক্ষ ছিলো না। তার উপর বৃষ্টি থাকার কারনে গাড়ির গতিও ছিলো কম।
বাসে থাকতেই অবশ্য ঝড়ের তান্ডব টের পেলাম। রাস্তার দুপাশে গাছগুলো যেন উড়ে চলে যাবে। ঝড় শুরু হওয়ার পর চোখের সামনেই রাস্তার উপর গাছ উপড়ে পড়লো। আমরা বেশ দূরে ছিলাম দেখে কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না।
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পর বিকাল ৩টায় কক্সবাজার পৌঁছাই। বাস স্টেশন থেকে অটো নিয়ে সোজা সমুদ্র সৈকতে চলে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে ঝড় শেষ। তাছাড়া কক্সবাজারে ঝড় সেভাবে আঘাত হানে নাই।
ঝড়ো বাতাসের ভিডিও
ঝড় না থাকলেও বাতাসের তোড় ছিলো অনেক। কক্সবাজারে এর আগেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কখনো দেখি নাই। আমরা তিনজন ঝাউবনের কাছে গিয়ে বসলাম।
আমার ধারনা ছিলো কক্সবাজারে কোন মানুষ থাকবে না। কিন্তু সেই তুলনায় অনেক মানুষ ছিলো। ঝড়ের মধ্যেও তারা পানিতে নামার চেষ্টা করতেছিলো। ট্যুরিস্ট পুলিশ এসে সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে বললো। তাদের কথা কেউ পাত্তা না দেওয়ায় কিছুক্ষন পর লাঠি দিয়ে বাড়ি শুরু করলো। তখন সবাই দূরে সরলো।
ঝড়ের সময় সমুদ্র ভয়ংকর সুন্দর রুপ ধারন করে। আমার একটা ইচ্ছা আছে। মহাসমুদ্রগুলোতে যে মাদার ভ্যাসেল চলাচল করে সেগুলোতে বসে ঝড় দেখবো!
সৈকতে ২ ঘন্টার মত থেকে উঠে পড়লাম। ঢাকা যেতে হবে। প্রথমে একটা হোটেলে ঢুকে ভর্তা-ভাজি দিয়ে খাবার নিয়ে নিলাম। এরপর আবারও সেই হানিফ বাসে উঠলাম। ৬.৩০ মিনিটে বাস ছাড়লো। তবে এবারের ড্রাইভার ভালো ছিলো। অন্য বাসের সাথে রেস করতে করতে ৪ ঘন্টার পরেই চট্টগ্রাম চলে আসলাম।
আমি আর রুপু চাইলে কক্সবাজার থেকে সরাসরি ঢাকার বাসে উঠতে পারলাম কিন্তু সাথে রিজভী থাকায় চট্টগ্রাম হয়ে যাবো ঠিক হয়। বদ্দার হাট নেমে এবার জি.ই.সি মোড় চলে গেলাম। ১১.০৫ মিনিটের ইউনিক বাসের টিকেট কাটলাম। রিজভী বিদায় নিয়ে ওর ভার্সিটিতে চলে গেলো।
জার্নির শেষটা খুব ভালো ছিলো। আমরা ইউনিকের যে বাসে উঠি সেটা একবারে নতুন বাস। আজকে প্রথম ট্রিপে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাবে। ইউনিক বাস আমার এমনিতেও প্রিয়। নন-এসি বাসের মধ্যে ইউনিক বাসের কোন তুলনা হয় না।
ভোরবেলা আমি যখন বাসায় ঢুকি তখন ঘড়িতে সময় ৪.৪৫ মিনিট! ২০ তারিখ রাত ৮টা থেকে ২২ তারিখ ভোর ৫টা পর্যন্ত ৩২ ঘন্টার মধ্যে ২৬ ঘন্টা শুধু জার্নিই করা হইছে। খরচ হইছে ১৮৫৫ টাকা। আর কক্সবাজার ছিলাম মাত্র ৩ ঘন্টা…
যাতায়াত খরচ
- ঢাকা-চট্টগ্রাম, মেইল ট্রেনঃ ১২০ টাকা
- চট্টগ্রাম রেলস্টেশন-বদ্দার হাট, বাসঃ ৫ টাকা
- বদ্দার হাট-কক্সবাজার, হানিফ বাসঃ ২২০ টাকা
- কক্সবাজার-বদ্দার হাট, হানিফ বাসঃ ২২০ টাকা
- বদ্দার হাট-জিইসি মোড়, বাসঃ ৫ টাকা
- চট্টগ্রাম-ঢাকা, ইউনিক বাসঃ ৪৬০ টাকা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন আনন্দ করার বিষয় নয়। একটু অসতর্কতা যেকোন বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই মজার ছলে অতি দুঃসাহসিক কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। আমরা যখন রওনা হয়েছিলাম বা যতটুকু সময় ছিলাম সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষা করেই ছিলাম।
Image Source: dhakatimes24.com