হন্টন প্রজেক্ট । দিন-১৫ঃ মিরপুর-১ টু বাংলানগর

ঢাকার রাস্তায় দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার শুরু সেই ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ তে। সেসময় কয়েকমাস বেশ হাঁটাহাঁটি হয়েছিল। হঠাৎ ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখের পর থেকে দীর্ঘদিন শহুরে রাস্তায় দীর্ঘক্ষন হাঁটা হয় না। মনের ভিতর তাড়না ছিলো কিন্তু জীবনের তাগিদে সে তাড়ানো চাপা পড়ে রয়েছিলো।

১১ জানুয়ারী, ২০১৭ দুপুরবেলা ‘এনামুল হাসান’ ভাইয়ের লেখা আমার অতি প্রিয়, “হেল দ্য হাইওয়ে (পায়ে হেঁটে চট্টগ্রাম…)” পড়তে বসি। এই লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েই আমার ঢাকার রাস্তায় হন্টন প্রজেক্ট শুরু হয়। কয়েক প্যারা পড়েই মাথায় আসে অনেকদিন হাঁটা হয় না। তবে আজই একটা হন্টন হয়ে যাক।

হাঁটা এক আজব নেশা! ঢাকার ধূলোবালিময়, ভাঙাচোরা রাস্তায় হাঁটার মাঝে সুখ খুঁজে পাওয়া আজবই বটে। যে পথ গাড়ি চড়ে পাড়ি দেওয়া যায় সে পথে হেঁটে বেড়ানো পাগলামি ছাড়া আর কি! তবে এ পাগলামি মনে শান্তি আনে, এ পাগলামি চোখ মেলতে শেখায়, এ পাগলামি তুচ্ছ বিষয়গুলোকেও ভালোভাবে বুঝতে শেখায়, নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।

সরিষার মৌসুম শুরু হয়েছে ঢাকার আশেপাশে সরিষা চাষ হয় এমন জায়গা খুঁজতেছিলাম। সমস্যা হলো ঢাকার কাছেপিঠে নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ছাড়া কোথাও ব্যাপকহারে সরিষার চাষ হয় না। সেদিন ‘টিওবি’র এক পোস্টে দেখলাম কেরানীগঞ্জের বাংলানগর গ্রামে সরিষার চাষ হয়। বাংলানগর আমার বাসা থেকে হাঁটা পথে তিন ঘন্টার রাস্তা। রথ দেখা হবে, কলাও বেঁচা হবে এই কথা চিন্তা করে ঠিক করলাম বাংলানগর হেঁটে যাবো।

দুপুর ১টা ৩৬ মিনিট। বেশ তাড়াহুড়ো করেই বাসা থেকে বের হলাম। তিন ঘন্টার রাস্তা দ্রুত না গেলে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তখন আর সরিষা ফুল দেখতে পারবো না। আমার বাসা থেকে চাইনিজ বাস স্টপেজ যেতে সাধারনত সময় লাগে ১০-১১ মিনিট। আজ সেখানে ৮ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম। এখন চাইনিজ থেকে কয়েকভাবে আটিঁবাজার যেতে পারি;

  1. টেকনিক্যাল-> আসাদ গেট-> মোহাম্মদপুর বাসষ্ট্যান্ড-> বসিলা ব্রিজ-> আটিঁবাজার
  2. টেকনিক্যাল-> শ্যামলি-> মোহাম্মদপুর বাসষ্ট্যান্ড-> বসিলা ব্রিজ-> আটিঁবাজার
  3. টেকনিক্যাল-> গাবতলী-> গাবতলী-সদরঘাট লিংক রোড-> বসিলা ব্রিজ-> আটিঁবাজার
  4. মিরপুর-১-> মাজার রোড-> গাবতলী-সদরঘাট লিংক রোড-> বসিলা ব্রিজ-> আটিঁবাজার

আমি ৪নং পথে রওনা হলাম। মাজার রোড দিয়ে আগে কখনো হাঁটা হয় নাই বিধায় এই পথকে পছন্দ করা। চাইনিজ থেকে ১০ মিনিটে মাজার রোডের মাথায় চলে আসলাম। রাস্তা থেকে মিরপুর মাজারের ভিতরের কিছুটা দেখা যায়। ভিতরে একটা বড় গাছ দেখা যাচ্ছিলো। ভর দুপুরে দূর থেকে দেখতে কেমন রহস্যময় গুমোট লাগে। রহস্যময়তা এড়িয়ে পা বাড়ালাম। আরো অনেকদূর যাওয়া বাকি।

মাজার রোডটা বেশ দীর্ঘ। এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না। মাজার রোড দিয়ে হাঁটার সময় মিরপুর বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ দেখা যায়। এই স্মৃতিসৌধে প্রথম আসা হয়েছিলো স্কুলে পড়ার সময়। বন্ধুদের সাথে স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসেছিলাম যতদূর মনে পড়ে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। আবার আসতে হবে ভাবতে ভাবতে পা চালাতে থাকলাম। হাঁটার গতি ধরে রাখার জন্য একটা পন্থা বের করেছিলাম। সামনের পথচারীকে অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে হাঁটা। যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি পথচারীকে অতিক্রম করা। এতে করে হাঁটার গতি কখনোই কমে না। জোরে জোরে পদক্ষেপ দিতে দিতে একধরনের ছন্দের সৃষ্টি হয়। পা তখন সেই ছন্দে চলতে থাকে।

মাজার রোডের ফুটপাত মসৃন না হলেও হেঁটে বেশ আরাম। এমন ফুটপাতের সুবিধা হচ্ছে সর্বক্ষন নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয় না। চারপাশ দেখা যায়। বেশ অনেকগুলো বড় বড় বিল্ডিং দেখলাম রাস্তার দু’পাশে। কত দ্রুত বদলে গেছে সবকিছু চিন্তাই করা যায় না। শেলটেকের সবচেয়ে বড় প্রকল্প দেখলাম এই রাস্তার পাশেই। ব্যানারে যা দেখাচ্ছে তা যদি বাস্তবায়ন করে তাহলে আসলেই অনেক বড় প্রজেক্ট হবে।

মাজার রোডের লম্বা রাস্তা শেষ করতে সময় লাগলো ১৬ মিনিট। ২টা ১০ মিনিটে গাবতলী পাম্পের সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাবতলী থেকে রাস্তার পাশের বাসস্ট্যান্ড উঠিয়ে দেওয়ার পর এর চেহারাই বদলে গেছে। প্রশস্ত রাস্তা। প্রচুর ধূলো থাকলেও কোন আবর্জনা নেই। এমন রাস্তায় হেঁটে শান্তি। আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল দেখে বেশ অবাক হলাম। বিশাল বাস টার্মিনাল। এই রাস্তায় তো কম আসা হয় নি কিন্তু কখনো বাস টার্মিনাল খেয়াল করি নাই। এজন্য আমার হাঁটা পছন্দ। অনেক কিছু নজরে আসে। গাড়ি দিয়ে প্রতিদিন চলাচলের রোডকেও হাঁটার সময় বড় অচেনা মনে হয়। নতুন নতুন কতকিছু যে আবিষ্কার করা যায়।

দুপুর ২টা ১৯ মিনিট। গাবতলী-সদরঘাট লিংক রোডের মাথায় চলে আসছি। এখন শুরু হবে আসল যাত্রা। দীর্ঘ এই রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমাকে বসিলা যেতে হবে। এই রাস্তায় হাঁটা তো দূরে থাক আমি কখনো বাসেও চড়ি নি। গরুর হাট যখন বসে তখন যতদূর পর্যন্ত হাট থাকে ততদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছে। হাটের সময় যেখানে গরু থাকে এখন সেখানে ইটের স্তূপ।

আমার আগের সব হাঁটার সাথে এবারের একটা পার্থক্য আছে। আগের হাঁটাগুলো ছিলো নিশ্চিন্ত। উদাস মনে চারিদিক দেখে দেখে হাঁটতাম। এবার মনে মনে নানা হিসাব কষতে কষতে হাঁটছিলাম। এতে করে চারপাশ দেখা হচ্ছিলো না ঠিক মত। অবশ্য এ রাস্তায় দেখার মত তেমন আহামরি কিছু নজরে আসছিলো না। তবু দৃষ্টি আরেকটু প্রখর করলে হয়ত অনেক কিছুই নজরে আসতো।

ধূলোর সাগরে পা ডুবিয়েই যেন হাঁটছিলাম। কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটবো সে সাহসও করতে পারছিলাম না। গায়ের পাশ ঘেষে যেভাবে গাড়িগুলো যাচ্ছিলো কখন যে গায়েই উঠিয়ে দেয় তার কোন ঠিক নেই। তারচেয়ে ধুলোভরা পথই ভালো। কিন্তু এতে করে কষ্ট যেমন বেশি হচ্ছিলো তেমনি চলার গতিও কমে যাচ্ছিলো। তবুও নিরাপত্তার কথা ভেবে সেভাবেই এগোতে থাকলাম।

১ ঘন্টা ১৯ মিনিট একটানা হাঁটার পর রাস্তার পাশের এক টং দোকানে পানি খেতে থামলাম। বসার সাথে সাথে পা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দুই গ্লাস পানি খাওয়ার পর একটা মিনিপ্যাক চানাচুর নিলাম। ৭ মিনিটের মত জিরিয়ে নিয়ে আবার পথচলা শুরু। যখন মনে হচ্ছিলো আর বোধহয় বসিলার দেখা পাবো না ঠিক তখনই দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে চার রাস্তার মোড়ের দেখা পেলাম। ৫১ মিনিট লাগলো এই পথটুকু আসতে।

চার রাস্তার মোড় থেকে এবার গন্তব্য বসিলা ব্রিজ। সেখান থেকে আটিঁবাজার। ১৯ মিনিট হাঁটার পরই বসিলা ব্রিজের মাথায় চলে আসলাম। ব্রিজের উপর উঠে একটু জিরিয়ে নিলাম। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে বড় বড় মালবাহী ট্রলারের আনাগোনা দেখতে বেশ লাগছিলো। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার দেখে ইচ্ছা করছিলো নিচে নেমে ট্রলার দিয়ে ঘুরে বেড়াই কিছুক্ষন।

বসিলা ব্রিজে প্রথম আসা হয় কয়েকমাস আগে এক বৃষ্টির দিনে। প্রথম দেখাতেই ব্রিজটা পছন্দ হয়েছিলো। মন ভালো করে দেবার মত একটা জায়গা। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদী দেখলে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। জীবনের সব কষ্টগুলোকে তখন তুচ্ছ মনে হয়। শেষ বিকেলের পশ্চিম আকাশে অস্তগামী সূর্যটা কষ্টে থাকা মানুষের সব কষ্টগুলোকে শুষে নিয়েই যেন ঘুমিয়ে পড়ে। বসিলা ব্রিজ; কষ্ট ভুলে যাওয়ার এক জায়গা।

আটিঁখাল ব্রিজের উপর এসে আমি অবাক। খাল শুকিয়ে পানি নেই বলতে গেলে। কয়েকমাস আগে বর্ষার সময় কত পানি দেখে গিয়েছিলাম। সরু ব্রিজ থেকে নেমেই আটিঁবাজারের বিখ্যাত হালিমের দোকান। হালিম খেতে থামলাম। আটিঁবাজার আসলে হালিম খাওয়া বাদ যায় না কখনো। ঢাকার অন্য সব হালিমের থেকে এখানের হালিমের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। হালিম খেয়ে রওনা হলাম বাংলানগর গ্রামের দিকে। যেখানে গেলে দেখা পাবো হলুদের রাজ্যের।

আটিঁবাজার ছাড়িয়ে কিছুদূর হাঁটতেই গ্রাম্যভাব চলে এলো। মনে হচ্ছিলো আমি যেন দূরের কোন গ্রামে চলে আসছি। গ্রামের মেঠো পথের সাথে এখানের পার্থক্য পাকা রাস্তা। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে চলে আসলাম কাঙ্খিত গন্তব্য বাংলানগর গ্রামে। কিন্তু হায়, সরিষা কোথায়। গ্রামের কোথাও সরিষা খুঁজে পেলাম না। তবে সময় খারাপ যায় নি। গ্রামের জীবনধারা দেখতে দেখতে সময় ভালোই কেটে গিয়েছিলো। অসাধারন একটা হোটেলের সন্ধান পেলাম সেখানে। পুকুরের পাড়ে হোটেল। হোটেলের পিছনের অংশে বারান্দার মত আছে সেখানে মাটিতে ম্যাট বিছানো। বিকেলে পেঁয়াজু, চপ, বুট দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে বসে বসে খেতে দারুন লাগবে। এবার সংগীর অভাবে চেয়ারে বসে চপ খেয়েই চলে আসলাম। আবার যাবো বাংলানগর গ্রামে। ভালো লেগে গেছে গ্রামটা। আজ প্রায় সাড়ে তিনঘন্টায় ১৪-১৫ কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে।

আজকের হাঁটার রুট,
বাস-> চাইনিজ-> মিরপুর-১-> মাজার রোড-> গাবতলী-> গাবতলী-সদরঘাট লিংক রোড-> বসিলা চার রাস্তার মোড়-> বসিলা ব্রিজ-> আটিঁবাজার-> বাংলানগর

রোজ বুধবার
১১ জানুয়ারি, ২০১৭

Feature Image by freepik

Spread the love