হন্টন প্রজেক্ট । দিন-১৩ঃ আফতাবনগর টু মিরপুর-১

১৮ দিন আগে প্রায় ১১ কিলোর বেশি হাঁটলেও মনের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে খুঁতখুঁত করছিলো; কতদিন হাঁটি না, কতদিন হাঁটি না। গতকাল রাতে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে ভার্সিটি থেকে হেঁটে বাসায় যাবো। ৩ টায় পরীক্ষা দিতে ঢুকে যথারীতি বাঁশ খেলাম(কিছু পড়ি নাই তাই)। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে হালকা নাস্তা করলাম। তেলে ভাজা জিনিস খাওয়ায় বেশ অস্বস্তি লাগতেছিলো কিন্তু পাত্তা দিলাম না।

আজকের রুট হিসেবে ঠিক করলাম কালসী এবং পূর্বাচল ফ্লাইওভারের রুট। এই রুটে অনেকদিন ধরে হাঁটার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু হচ্ছিলো না। ভার্সিটির সামনে থেকে ঠিক ৫ টায় রওনা করলাম। হাঁটা শুরু করার আগে মোবাইলে এন্ডোমন্ডো চালু করে নিলাম। কতদূর কি হাঁটলাম ট্রেক রাখা যাবে।

বিকাল হয়ে আসলেও রোদ ছিলো বেশ। তবে বাতাস থাকায় তেমন গরম লাগছিলো না। শুরু হিসেবে ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম। সমস্যা হলো ফুটপাত। রামপুরা থেকে বাড্ডা যাওয়ার পথে ফুটপাত বলতে কিছু নেই। হাঁটতে হচ্ছিলো বেশ ঘুরে ঘুরে। বাড়তি পরিশ্রম হচ্ছিলো। মধ্যবাড্ডার কাছে এসে যে পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম সে পাশে আর হাঁটাই যাচ্ছিলো না। রাস্তা পার করে ওপর পাশে চলে গেলাম। এপাশে তাও হাঁটার মত কিছুটা অবস্থা আছে। এইরকম ফুটপাতে হাঁটলে আমার ক্যান্টমেন্টের ফুটপাতের কথা মনে পড়ে। ওদের ফুটপাতগুলো কত সুন্দর। হেঁটেও মজা, পায়েরও শান্তি।

হাঁটতে হাঁটতে হোসেইন মার্কেটের অপজিটে কুয়েতী মসজিদের ওইখানে অসম্ভব মজাদার ডাল পুড়ি আর সস পাওয়া যায় সেটাই শুধু মাথায় ঘুরতেছিলো। এটার সামনে দিয়ে যখন যাবো তখন খেয়ে যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। ২৪ মিনিটের মাথায় পুড়ির দোকানে হাজির হলাম। গরম গরম পুড়ির অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম। হোটেলের বাইরে তাকিয়ে মন ভরে গেলো। বেশ কয়েকজন মুরব্বী বয়সী আংকেল মনে খুলে আড্ডা দিচ্ছে আর বাইরে দাঁড়িয়ে পুড়ি খাচ্ছে। পুড়ি খাওয়া শেষে এরপর গেল টং দোকানে চা খেতে। চা খেতে খেতে একে অপরের সাথে দুষ্টমিও করছে। ঘুনে ধরা শহরে এসব ছোটখাটো ঘটনা দেখে বড়ই শান্তি লাগে।

খাওয়া শেষে ১০ মিনিটের মধ্যে আবার হাঁটা শুরু করলাম। একটু আগেই পুড়ি খেয়ে আবার পুড়ি খাওয়ায় গ্যাসের চাপে বুকে ব্যাথার মত শুরু হয়ে গেল। তেমন পাত্তা না দিয়ে হাঁটা বজায় রাখলাম। সুভাস্তু টাওয়ার পার হওয়ার পর মনে হলো জোরে হাঁটা দরকার। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। নতুন বাজার থেকে নর্দা যাওয়ার ফুটপাতটা বেশ ভালো। আর রাস্তা চওড়া হওয়ায় হেঁটে শান্তি। একেবারে গাঁ ঘেষে গাড়ি যায় না। যদিও সে শান্তি বেশিক্ষন ছিলো না। কিছুক্ষনের মধ্যে পায়ের তলা বিদ্রোহ ঘোষনা করলো। আমার পায়ে যে স্যান্ডেল সেটা জোরে হাঁটলেই আর সুবিধা হয় না। পায়ের তলা গরম হয়ে যায়। কি আর করা, পায়ের সাথে যুদ্ধ চালিয়েই হাঁটতে থাকলাম।

সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে আমার কাঙ্ক্ষিত ফ্লাইওভারের কাছে চলে আসলাম। এই ফ্লাইওভার হেঁটে পার হওয়ার ইচ্ছা বহুদিনের। ফ্লাইওভারে উঠে দেখি অনেক মানুষ ফ্লাইওভারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যের অস্তমিত আলোয় চারপাশ দেখতেও সুন্দর লাগেছিলো। ৭ মিনিটেই ফ্লাইওভার থেকে নেমে গেলাম। এবার পায়ের বিশ্রাম দরকার।

ফ্লাইওভার থেকে নেমে হাতের বামে রেললাইনের উপর যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। সেই রাস্তা দিয়ে রেললাইনের উপর গিয়ে বসলাম। আপনমনে মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছি হঠাৎ এক লোক বললো ভাই উঠেন। ট্রেন আসতেছে। শুনেই লাফ দিয়ে উঠে গেলাম। পিছে তাকিয়ে দেখলাম ট্রেন বহুদূর। একটু দূরে গিয়ে ট্রেনের ভিডিও করার জন্য দাঁড়ালাম। ট্রেন আসার পর দেখি বেশি কাছেই দাঁড়িয়ে পড়েছি। ট্রেনের বাতাসে ছিটকে পড়লাম মনে হলো। মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা ধরলাম।

রেডিসনের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করলাম অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, মাটিকাটা রোডে রাতে হাঁটা কি ঠিক হবে? আর ফ্লাইওভারের উপর তো পুলিশ থাকে যদি হেঁটে পার হতে না দেয়। এসব চিন্তা করতে করতে ফ্লাইওভারে উঠে গেলাম। শান্ত নির্জন ফ্লাইওভারের অন্যরকম এক মাধুর্য আছে যদিও বেশিক্ষন নির্জন থাকে না। উপর থেকে শহরটাকে দেখতেও বেশ লাগে। এই ফ্লাইওভার আমি আগেও হেঁটে পার হয়েছি। সেবার ইসিবি থেকে কুর্মিটোলার দিকে যাচ্ছিলাম আর এবার উল্টোটা। পুলিশ ধরবে যেই ভয় পাচ্ছিলাম সেরকম কিছু হলো না। পুলিশ কিছু বললো না। তারা বাইক ধরায় ব্যস্ত।

এই ফ্লাইওভারে হাঁটার সমস্যা হচ্ছে, বেশি সংকীর্ণ। হাঁটতে ভয় লাগে। কখন গাড়ি বা বাস এসে উড়িয়ে দেয়। একেবারে রেলিংএর ধার ধরে হাঁটতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পিছলা খেলাম। মাটি ভিজে পিছলা হয়ে আছে। ফ্লাইওভারে হাঁটার শর্ত হচ্ছে সবসময়ই সাবধানে থাকতে হবে। একটু বেখেয়াল হলেই বিপদ। আজকে কয়েকবার বেখেয়াল হয়ে হাঁটতে গিয়ে মাইক্রো একেবারে গাঁ ঘেষে গিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে আমি ফুটপাতে নই তাদের রাজ্যে আছি।

পুলিশ না ধরলেও অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আর্মির গাড়ি এসে পাশে থামলো। জিজ্জাসা করলো,

কি করেন?
জ্বি, স্টুডেন্ট।
কোথা থেকে আসছেন?
রামপুরা।
কই যাবেন?
মিরপুর-১।
হাঁটতেছেন কেন?
আমার সরল উত্তর, আমি হাঁটি। মাঝেমধ্যেই হেঁটে বাসায় যাই।
একটু মুচকি হেসে, আপনি হাঁটেন?
আমি বললাম, জ্বি।
প্রশ্ন করলো, এই অন্ধকারে ফ্লাইওভারে একা হাঁটা ঠিক?
জ্বি না। আসলে বুঝি নাই যে অন্ধকার হয়ে যাবে।
এরপর বললো আচ্ছা ঠিক আছে। অন্ধকারে হাঁটবেন না।

আমি আশা করছিলাম বলবে চলেন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমি ভাব নিয়ে বলবো, না আমি যাবো না। আমি হেঁটেই যাবো। তেমন কিছু হলো না দেখে দুঃখ পেলাম।

আগের বার এই ফ্লাইওভার পার হতে ২২ মিনিট লেগেছিলো, এবার লাগলো ১৬ মিনিট। কিন্তু পায়ের অবস্থা যা তা। পায়ের তলা আর হাঁটুতে মনে হচ্ছে যেন আগুন জ্বলতেছে। ইসিবি চত্বরের এক টং দোকানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে একটু জিরিয়ে নিলাম। হাঁটতে মন চাচ্ছিলো না আর কিন্তু আমি সংকল্পবদ্ধ। হেঁটেই বাসায় যাবোই।

মিনিট দশেক হাঁটার পর আর পারলাম না। বসে পড়তে হলো। মাটিকাটা রোডের এই অংশটাতে বাতাসও ছিলো বেশ। প্রায় ২০ মিনিট বাতাস খাওয়ার পর যখন প্রথম পা ফেললাম মনে হলো যেন পায়ের তলা কেটে ফেলে দেই। আর হাঁটা সম্ভবই না। কিন্তু আমার থামাথামি নেই। হাঁটবোই…

কালসী মোড়ে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম একটানে হেঁটে বাসায় যাবো তা সে যত কষ্টই হোক। এই মনোবলে এগিয়ে চললাম কিন্তু বাসা দূরে থাক পূরবী বাসষ্ট্যান্ডকেই মরিচীকা মনে হচ্ছিলো। যত হাঁটি কাছে আর আসে না। পূরবী বাসষ্ট্যান্ড এসে নতুন মরিচীকা পেলাম কেএফসি। কেএফসি পার হওয়ার পর মনে আবার জোর পেলাম। কাছাকাছি চলে আসছি। আর ৩০-৩৫ মিনিট হাঁটলেই হবে।

ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে এসে মন খুশি খুশি হয়ে গেল। এইতো এখান থেকে আর বেশি দূর না।
মিরপুর-১০ গোলচক্কর এককালে কত শান্ত জায়গা ছিলো। আর এখন হাঁটাই মুশকিল। এত মানুষ, এত মানুষ। গাড়ির জ্যাম তো আছেই, এখানে মানুষেরও জ্যাম লেগে যায়। আর ফুটপাত তো নয় যেন দোকান। হাঁটার জায়গা নেই। রাস্তায়ও হাঁটার উপায় নেই। চারিদিকে বাস, রিকশা, মোটর সাইকেলে গিজগিজ করছে। চরম বিরক্তি নিয়ে ৬০ ফিট রোডে ঢুকলাম। এরপর কিভাবে কিভাবে যে নিজেকে টেনে বাসায় আসলাম নিজেও জানি না।প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের মত টানা হাঁটছি। বাসার সামনে এসে গেটে দাঁড়িয়ে মোবাইল বের করে দেখি ৪ ঘন্টা হতে এখনো ৩ মিনিট বাকি! ৩ ঘন্টা ৫৭ মিনিটে আজ হাঁটা হয়েছে প্রায় ১৬.৯৩৭ কিলোমিটার।

আজকের হাঁটার রুট,
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি-> মেরুল বাড্ডা-> মধ্য বাড্ডা-> উত্তর বাড্ডা-> নতুন বাজার-> নর্দা-> বসুন্ধরা-> পূর্বাচল ফ্লাইওভার-> কুর্মিটোলা-> কালসী ফ্লাইওভার-> পূরবী-> মিরপুর-১১-> মিরপুর-১০-> ৬০ ফিট রোড-> মনিপুর স্কুল-> কাশেমের দোকান-> জোনাকি রোড-> বাসা

রোজ শুক্রবার
১২ আগস্ট, ২০১৬

Feature Image by istock

Spread the love